দিবালার রত্ন হয়ে ওঠার গল্প

ফুটবল বিশ্বে আর্জেন্টিনা জনপ্রিয় এক নাম। দিয়েগো মারাদোনার দেশ, লিওনেল মেসির জন্মভূমি। সেই দেশের ছোট্ট শহর লাগুনা লার্গা সম্ভবত একমাত্র জায়গা যেখানে মারাদোনা-মেসির নাম পরে আসে। এখানেই যে বেড়ে উঠেছেন পাওলো দিবালা।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2020, 05:19 AM
Updated : 21 April 2020, 05:29 AM

ওপর থেকে দেখলে আর্জেন্টিনার অন্য ছোট শহরগুলোর সঙ্গে লাগুনা লার্গার কোনো পার্থক্য নেই। কৃষিনির্ভর এই শহরে আছে একটি প্রধান মোড়, দুটি পেট্রোল স্টেশন, একটি বিদ্যালয়, একটি যাদুঘর আর দুটি ফুটবল ক্লাব।

আর্জেন্টিনার তিনটি মূল শহর করদোবা, রোজারিও ও বুয়েনস আইরেসকে সংযোগ করা রাস্তার রুতা নুয়েভোর এক জায়গায় বিশাল এক বিলবোর্ডে লেখা, ‘এটি পাওলো দিবালার শহর।’

দুই বছর আগে ইউভেন্তুস ফরোয়ার্ড দিবালার ২৫তম জন্মদিনের উপহার এটি, যা দিয়ে তার রাজত্বের সীমানা বোঝানো হয়েছে। বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত দিবালা নামে। কিন্তু এখানে তাকে কেউ ওই নামে ডাকে না। ছোট্ট শহরের সাড়ে সাত হাজার মানুষের কাছে তিনি পাওলো।

এখানেই কেটেছে শৈশব। পরিবারে তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। ফুটবলের প্রতি ছোট ছেলের ভালোবাসা দেখে বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন, পেশাদার ফুটবল খেলবে পাওলো। একদিন অনেক বড় তারকা হবে, যদিও এর কিছুই দেখে যেতে পারেননি তিনি।

শহরের ঠিক মাঝ দিয়ে গেছে মূল রাস্তা। এর দুই পাশে আছে দুটি ফুটবল ক্লাব, স্পোর্তিভো ও নিওয়েলস। দিবালার বাবা-মা এসেছেন শহরের দুদিক থেকে। মায়ের পরিবার সমর্থন করতো স্পোর্তিভোকে আর বাবা আদোলফো ও দাদা বোলেস্লভ সমর্থন করতেন নিওয়েলসকে।

আর্জেন্টিনায় বোলেস্লভ ছিলেন পোলিশ অভিবাসী। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে বন্দি হলে নাৎসি জার্মানিতে তাকে পাঠানো হয়েছিল কাজের জন্য। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে কোনো কাজ না পেয়ে তিনি পরবর্তী ঠিকানা হিসেবে আর্জেন্টিনাকে বেছে নেন। দিবালার বয়স যখন চার বছর, তখন তিনি মারা যান।

দিবালার ফুটবল জীবনের শুরু স্পোর্তিভোয়। করদোভার অন্যতম বড় ক্লাব ইন্সতিতুতোয় অনুশীলনের প্রস্তাব পেয়ে ১০ বছর বয়সে সেখানে যোগ দেন তিনি। শুরুতে বাবার সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ি থেকেই অনুশীলন করতে যেতেন। আদোলফো গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে নিয়ে যেতেন, অনুশীলন শেষে আবার নিয়ে আসতেন। বাবা-ছেলের প্রতিদিন যাওয়া-আসা করতেন ১৫০ কিলোমিটার পথ!

প্রতিটি দিন যেন ছেলের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সেই স্বপ্ন তরীতে হঠাৎ করেই টালমাটাল হয়ে যায় এক ঝড়ে। আদোলফোর শরীরে টিউমার ধরা পড়ে। থমকে যায় অনুশীলন। দিবালার বয়স তখন ১৫-অপেশাদার ফুটবল থেকে পেশাদার অঙ্গনে এগোনোর সময়। কিন্তু বাবার শেষ দিনগুলোতে তার পাশে থাকতে ক্লাব থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে বাড়িতে চলে আসেন দিবালা।

আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে ইন্সতিতুতোর ‘বি’ নাসিওনালে দিবালার পাশে অভিষেক হওয়া পাবলো বুরজিও জানালেন, দিবালার সেই কঠিন সময়ের কথা, সেদিনের ছোট্ট পাওলোর আজকের দিবালা হয়ে ওঠার নানা ধাপ।

“পাওলোর স্বপ্ন ছিল, তাকে শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে দেখবে তার বাবা। ওর বাবার চলে যাওয়াটা ছিল তার (দিবালার) জন্য অনেক বড় ধাক্কা।”

“তবে সে থেমে থাকেনি, এগিয়ে যেতে থাকে। কিছুদিন পর কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয় সে, অমন পরিস্থিতিতে যা খুব কম কিশোরই নিতে পারে; ইন্সতিতুতোর যুব অ্যাকাডেমিতে থাকতে মা-ভাইদের ছেড়ে করদোবায় চলে আসে।”

২০১৭ সালে ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দিবালা বলেছিলেন জীবনের সেই কঠিন সময়ের কথা।

“বাবার মৃত্যু আমার জন্য ছিল অনেক কষ্টের। ফুটবল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।”

“সবসময় আমি তার কথা ভাবি এবং আমার সব গোল তাকে উৎসর্গ করি। গোল করার পর আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ আমি নিশ্চিত সে দেখছে। একজন বাবার শূন্যস্থার পূরণ করা অসম্ভব। আমার কাছে আমার পরিবারই সব।”

প্রতিবার গোল করার পর মুখের দুইপাশে তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি নিয়ে দিবালার উদযাপনের ভঙ্গি আজ দারুণ জনপ্রিয়। তার ট্রেডমার্ক এই উদযাপনের পেছনের কারণ বলেছেন দিবালার আত্মজীবনীর লেখক মার্কোস ভিয়ালোবো। যে ভঙ্গিতে লুকিয়ে আছে তার জীবনের কঠিন সময়ের প্রতিফলন।

“নিজেকে যোদ্ধা প্রমাণ করতে এবং যে কখনও হার মানে না, তেমন দেখাতে চেয়েছিল দিবালা। আর সেজন্য গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমার ভক্ত দিবালা মাক্সিমাসের মুখোশ পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।”

ভিয়ালোবোই দিবালার ডাকনাম দিয়েছিলেন ‘লা হোয়া’, যা এখনও আছে। তার জীবনীগ্রন্থের নামও এই, যার অর্থ ‘রত্ন’।

“সে ছিল ইন্সতিতুতো অ্যাকাডেমির আকাটা হীরার মতো। আমি পাওলোকে একবার এই ডাকনাম নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে হেসে বলেছিল, এটা তার পছন্দ হয়েছে।”

ভীষণ কঠিন সে সময়ে কিছু সুবিধাও পেয়েছিলেন দিবালা। ওই সময়ে ইন্সতিতুতোর সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিলেন তিনি ও বুরজিও। ৭০ বছর বয়সী এক দম্পতির সঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকার প্রস্তাব পেয়েছিলেন তারা দুজন। নাতনিদের সঙ্গে থাকতেন ওই দম্পতি। ক্লাবের অ্যাকাডেমির আবাসনের চেয়ে যা অনেক ভালো ছিল বলেও জানান বুরজিও।

“আমরা চার খেলোয়াড় দুই রুমে থাকতাম। বাড়িতে তৈরি খাবার ও একটা পরিবারের সান্নিধ্যে আমরা যেন ভিআইপি ভাবে ছিলাম। বিশেষ করে ক্লাবের আবাসনের ব্যবস্থার তুলনায়, যেখানে স্টেডিয়ামের গ্যালারির নিচের ঘরগুলোয় ঘুমাতে হতো।”

“তবে, থাকার ব্যবস্থা যাই হোক না কেন, যেকোনো ভাবেই পাওলো প্রস্তুত ছিল স্বপ্ন পূরণের জন্য এবং যে কথা সে তার বাবাকে দিয়েছিল তা পূরণের জন্য।”

দিবালার আরও বড় মঞ্চে উঠে আসার পথে উল্লেখযোগ্য একটি দিন ২০১১ সালের ২৯ জুন। ইন্সতিতুতোর দ্বিতীয় বিভাগের প্রাক-মৌসুমের অনুশীলন চলছিল।

তরুণ দিবালার সেদিনের ড্রিবলিং, বল নিয়ে কারিকুরি চোখে ধরেছিল কোচ দারিও ফ্রাঙ্কোর। নিজের নোটবুকে তিনি লিখলেন, “পাবলো দিবালা, ক্যাটাগরি ১৯৯৩, নাম্বার নাইন।”

পরের মৌসুমের দল নির্বাচনের জন্য অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়দের দেখতে এসেছিলেন ফ্রাঙ্কো। দিবালার প্রতিভা এতটাই চোখধাঁধানো ছিল যে, কোচ তার নোটবুকে যে ভুল বানানে লিখেছিলেন নাম, তা ঠিক হতে সময় নেয়নি মোটেও।

দুই মাস পর লিগ শুরুর প্রাক্কালে ফ্রাঙ্কো পড়লেন দল নির্বাচন জটিলতায়। ক্লাবের রেকর্ড দামে কেনা খেলোয়াড় ছিলেন নিষিদ্ধ, মূল দলের আরও দুই স্ট্রাইকারের ছিল চোট।

মার্কো বিয়েলসার শিষ্য ফ্রাঙ্কো কোনো উপায় না দেখে নজর দিলেন তিন উঠতি তারকার দিকে। গ্রীষ্মের অনুশীলনে যারা তাকে মুগ্ধ করেছিল; বুরজিও, নিকোলাস লোপেস ও ১৭ বছর বয়সী দিবালা। সবার চুল ছিল খুব করে ছাটা, যেন আর্মি কমান্ডো।

তিন জনেরই চুলের এমন ‘আর্মি ছাট’ প্রসঙ্গে বুরজিও জানান, এটা কাকতালীয় কোনো ঘটনা ছিল না। দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা নতুনদের এমন করে ছেটে দিত। এটা একটা অঘোষিত নিয়মের মত ছিল। দিবালা নাকি তখন বড় চুল রাখতে পছন্দ করতেন। বুরজিও নিজেও। তাই বড়দের অমন কাণ্ডে নাকি দিবালা ও তার ফ্যাশন নষ্ট গিয়েছিল, মজা করে বলেন বুরজিও।

২০১১-১২ মৌসুমের দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবলে সবার আলাদা নজর ছিল। কারণ, সেবার শীর্ষ সারির দল রিভার প্লেট তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গিয়েছিল।

ইন্সতিতুতোর শুরুটা বেশ ভালো ছিল; হারিকেনকে তারা ২-০ গোলে হারিয়েছিল। ৭১ মিনিট মাঠে থেকে দারুণ পারফরম্যান্সে নজর কেড়েছিলেন দিবালা। পেশাদার ফুটবলে অভিষেক ম্যাচে যদিও একটা হলুদ কার্ড দেখেছিলেন তিনি।

ওই মৌসুমে লিগে ১৭ গোল করেছিলেন দিবালা, এর মধ্যে ছিল দুটি হ্যাটট্রিক-কিংবদন্তি মারাদোনার চেয়ে অল্প বয়সে যে কীর্তি গড়েছিলেন তিনি।

ইন্সতিতুতোয় দিবালার প্রথম কোচ ওয়াল্তার সারাকোর মতে, সে ছিল সহজাত লেফট-উইঙ্গার।

“সে ছিল দারুণ ক্ষিপ্র এবং দুর্দান্ত এক ড্রিবলার। মাঠের যেকোনো জায়গায় খেলতে পারত। দারুণ বিনয়ী ছিল, কখনও রেগে যেত না এবং খুব স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিত।”

“কিছু মেধাবী খেলোয়াড়, বিশেষ করে শিশু বয়সের মেধাবীরা একটু অবাধ্য হয়। কিন্তু পাওলোর বিদ্রোহী মনোভাব কেবল মাঠেই প্রকাশ পেত।”

অভিষেক মৌসুমের অসাধারণ পারফরম্যান্সে দিবালা নজর কাড়েন আরও বড় সীমানায়। এল গ্রাফিকো নামের একটি ফুটবল ম্যাগাজিন তার সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব জানতে পা দেয় লাগুনা লার্গায়। ঠিক যেভাবে তারা একসময় রোজারিওতে গিয়েছিল মেসির সম্পর্কে জানতে।

তবে দিবালার বড় ভাই বিনীতভাব তাদের জানিয়ে দেন, তাদের পরিবার পাদপ্রদীপের আলোর বাইরেই থাকতে চায়। কারণ হিসেবে জানান, দ্বিতীয় সারিতে খেলা এক ফুটবলারের সঙ্গে মেসির তুলনা করা এবং জাতীয় একটি ম্যাগাজিনের কাভারে তাকে জায়গা দেওয়াটা তাদের চোখে অনেক বেশি বলে মনে হয়েছে।

যদিও অল্প দিনেই সামনে চলে আসেন দিবালা। অভিষেক মৌসুম শেষের আগেই ৩০ লাখ ইউরোর প্রস্তাব পেয়ে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তার স্বত্ব বিক্রি করে দেয় ইন্সতিতুতো। আর এর চার গুণ অর্থ দিয়ে ২০১২ সালের এপ্রিলে তাকে কিনে নেয় ইতালির ক্লাব পালের্মো। তিন মাস পর ২০ জুলাই, চার বছরের চুক্তিতে দিবালাকে দলে টানার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় সেরি আর দলটি। ইউরোপীয় ফুটবলে পা পড়ে দিবালার।

দিবালাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত পালের্মোর প্রেসিডেন্ট মাওরিসিও জামপারিনি বলেছিলেন, “ইন্টার মিলান, পিএসজি ও চেলসির হাত থেকে আমরা নতুন সের্হিও আগুয়েরোকে ছিনিয়ে নিয়েছি।”

ইতালিতে নিজের প্রথম মৌসুমে দলের ‘বি’ লিগে নেমে যাওয়া দেখতে হয় দিবালার। তবে তার নিজের উন্নতির ধারা থেমে থাকেনি। ওই সময়ে এক মৌসুমের জন্য দলটির কোচ ছিলেন ইতালির সাবেক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জেন্নারো গাত্তুসো। 

সাবেক কোচের প্রশংসায় দিবালা একবার বলেছিলেন, “তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, কিভাবে প্রতিপক্ষের ট্যাকল ফাঁকি দিতে হয়। অনুশীলনে কখনও কখনও তিনি আমাকে মার্ক করতেন এবং লাথি মারতেন যেন আমি বুঝতে পারি যে, কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে।”

২০১৫ সালের ২৫ মে, অধিনায়কের ব্যান্ড পরে পালের্মোর হয়ে শেষবার মাঠে নামেন দিবালা। দলের সাফল্য ও প্রিয় সতীর্থের বিদায়-দুই উপলক্ষ্যকে রাঙাতে ম্যাচ শেষে দিবালাকে বাতাসে ছুঁড়ে উদযাপন করে পালের্মোর খেলোয়াড়রা।

২১ বছর বয়সে তিন কোটি ২০ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফিতে পরের মৌসুমে ইউভেন্তুসে যোগ দেন দিবালা। শুরু হয় বর্ণিল ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়।

নতুন ঠিকানায় শুরুতে আন্দ্রেয়া পিরলোর ছেড়ে যাওয়া ২১ নম্বর জার্সি পান দিবালা। পরের বছর পল পগবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়ে ফাঁকা হয়ে যায় বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সিটি। মিশেল প্লাতিনি, রবের্তো বাজ্জিও ও আলেস্সান্দ্রো দেল পিয়েরোরা যে জার্সি পরে খেলেছেন, তা দিবালাকে দিতে খুব একটা ভাবতে হয়নি ইউভেন্তুসকে।

দিবালাও আস্থার প্রতিদান দিতে দেরি করেননি। খুব দ্রুত তিনি হয়ে ওঠেন ইউভেন্তুসের আক্রমণের মূল কারিগর। প্রথম মৌসুমে লিগে করেন ১৯ গোল, করান ৯টি। গোলের হিসেবে সবচেয়ে ভালো সময় তার কাটে ২০১৭-১৮ মৌসুম। দলের টানা সপ্তম সেরি আ জয়ের পথে করেন ২২ গোল, অ্যাসিস্ট ৫টি। টানা তিনবার জায়গা করে নেন সেরি আর বর্ষসেরা দলে।

মাঠে সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে ভালো পারফর্ম করতে পারেন ওইসব খেলোয়াড়, যারা খুবই প্রতিভাবান, ঠাণ্ডা মাথার। দিবালা তাদের মত একজন।

দিবালার নানা দিক বলতে গিয়ে গিয়ে সাবেক নিওয়েলস সতীর্থ লরেন্সো কোর্তিয়ানো ছোটবেলার একটি ঘটনা সামনে আনেন।

“একরাতে, আমরা গ্রামের দিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম, বারবিকিউ হচ্ছিল। আমরা গায়ে কেরোসিন মাখানো একটা বল দেখলাম। সেটিতে আগুন ধরিয়ে খেলা শুরু করলাম। কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ খেলা, তাই নয় কি?”

“পাওলোর সঙ্গে আমরা মাঝে মধ্যে এমন করতাম। শেষদিকে বলটি ফেটে গিয়েছিল, ঠিক যখন আমাদের খাওয়ার সময় হয়েছিল।”

ইন্সটাগ্রামে আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের মধ্যে মেসির পর সবচেয়ে বেশি অনুসারী দিবালার, প্রায় চার কোটি। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমে তিনি শেয়ার করেন তার বুট, ব্র্যান্ড লোগো, তার বিখ্যাত ‘মুখোশ পরা’ উদযাপন ও বান্ধবীর সঙ্গে তোলা ছবি। মাকে সঙ্গে নিয়ে ভক্তদের পাঠানো চিঠির জবাবও দেন দিবালা।

কিন্তু দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সাহায্য করার ব্যাপারটি তিনি জনসম্মুখে আনতে নারাজ। ভিয়ালোবোর কথাও ফুটে ওঠে তা।

“অনেক মানুষ আমাকে বলেছে যে দিবালা তাদের সাহায্য করেছে, কিন্তু কাউকে তা বলতে মানা করে দিয়েছে। কারণ সে এটা প্রচারের জন্য করে না।”

দিবালার এমন মনোভাব বিস্মিত করে না তার এক সময়ের সতীর্থ বুরজিওকেও।

“এটা আমাদের মোটেও অবাক করে না। কারণ পাওলো সবসময় এমনই ছিল। সে কখনও একটা কেক পেলে আমাদের সবার সঙ্গে ভাগ করে খেত। ছোটদের সে তার বুট দিয়ে দিত…যত বিখ্যাতই হয়ে যাক না কেন, সে কখনও পাল্টাবে না।”

রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বায়ার্ন মিউনিখের মত বড় বড় ক্লাব তাকে পেতে আগ্রহী বলে সংবাদমাধ্যমের খবর। আনুমানিক ১৩ কোটি ইউরো মূল্যের এই ফরোয়ার্ডের সৌভাগ্য হয়েছে সময়ের সেরা দুই ফুটবলার মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে খেলার।

কিন্তু দিবালার রাজ্যের মানুষ বুঝে পায় না, জাতীয় দলে সে কেন এত কম সুযোগ পায়। তবে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সাবেক প্রায় সব কোচদের মুখেই শোনা যায় একটা কারণ; মেসি ও দিবালা একই পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত হওয়ায় একাদশে একসঙ্গে তাদের খেলানো কঠিন।

২০১৭ সালে দিবালা নিজেও একবার এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। ব্যাখ্যা করেছিলেন কারণ।

“এটা কিছুটা অবাক করার মত, কিন্তু মেসির পাশে খেলাটা একটু কঠিন। কারণ, আমরা দুজনই একই পজিশনে খেলি।”

দিবালার ওই মন্তব্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বার্সেলোনা তাকে কিনতে আগ্রহী থাকলেও তারপরই নাকি সে পরিকল্পনা বাতিল করে দেয় তারা। ওই সময়ের আর্জেন্টিনা কোচ এদগার্দো বাউসাও তার পরিকল্পনা থেকে দিবালাকে ছেটে ফেলেন।

পরবর্তী কোচ হোর্হে সাম্পাওলির দলেও দিবালার অবস্থান ছিল ভীষণ নড়বড়ে। রাশিয়া বিশ্বকাপের স্কোয়াডে ডাক পেলেও টুর্নামেন্টে সুযোগ পান মাত্র একটি ম্যাচে। শোনা যায় মূল মিশনে নামার আগে সাম্পাওলি নাকি ২১টি ভিন্ন ফরমেশনে অনুশীলন করিয়েছিলেন, কিন্তু একটিতেও ছিলেন না দিবালা।

গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে বেঞ্চে গা গরম করার পর নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। কিন্তু শেষ ষোলোয় আবারও থাকতে হয় একাদশের বাইরে, ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নেয় দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

তবে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় দিবালা যে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছে, তা বলা যায়। গত বছরের কোপা আমেরিকার পর অঘোষিত বিরতি নিয়েছিলেন মেসি, তখন নিয়মিত একাদশে ছিলেন দিবালা।

আগামী জুনে ৩৩ বছরে পা দিতে যাচ্ছেন মেসি। মেসি পরবর্তী সময়ে দিবালাকে ঘিরেই যে আর্জেন্টিনার কোচ পরিকল্পনা সাজাবেন, তা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনির অধীনে ইতোমধ্যে তা দেখাও গেছে। দুই যুগের বেশি সময়ের শিরোপা খরা কাটানোর লক্ষ্য নিয়ে আগামী কোপা আমেরিকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আর্জেন্টিনা। ১৯৯৩ সালের পর থেকে ছয়টি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারেনি দেশটি।

তাই মেসির মত দিবালার কাঁধেও যে দেশের শিরোপা খরা কাটানোর পাহাড়সম ভার পড়তে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে আগুনে বল নিয়ে খেলা যার অভ্যাস, সেই লাগুনা লার্গার পাওলো নিশ্চয় জানেন, চাপকে কিভাবে জয় করতে হয়।