পাইওনিয়ার, তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম বিভাগ এবং চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ-ফুটবলার তৈরির এই ধাপগুলোতে সীমাবদ্ধতার শেষ নেই। মাঠ নেই। অর্থ নেই। নেই সময়োপযোগী পরিকল্পনা। বরং লেপ্টে আছে ম্যাচ গড়াপেটার কালি। ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) উদাসীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই, স্বজনপ্রীতি ও বয়সচুরিও হয় নিত্য।
ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনের শেষ পর্বে ম্যাচ গড়াপেটার পেছনের নানা কারণ জানানোর পাশাপাশি রেজাউল দিলেন ফুটবলকে এই বিষ থেকে মুক্ত করার পরামর্শও।
‘ফুটবলের ক্যান্সার’
২০১৯ সালে হওয়া সর্বশেষ প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে পাতানো ম্যাচে খেলে শাস্তি পায় ফ্রেন্ডস সোশাল ওয়েলফেয়ার ও ঢাকা ইউনাইটেড ক্লাব। ঘরোয়া ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ২০১৫-১৬ মৌসুমে পাতানো ম্যাচ খেলার অভিযোগ ওঠে ভিক্টোরিয়া এফসি-টিঅ্যান্ডটি ম্যাচ নিয়ে; এ ম্যাচে প্রভাব রাখার অভিযোগ ছিল আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের বিপক্ষে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে ম্যাচ গড়াপেটা করে শাস্তি পায় সিটি ক্লাব ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব।
প্রিমিয়ার লিগেও বিভিন্ন সময়ে পাতানো ম্যাচের অভিযোগ উঠেছে। প্রমাণিতও হয়েছে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব-টিম বিজেএমসি, ফরাশগঞ্জ-শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব এবং সাইফ স্পোর্টিং-রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস অ্যান্ড সোসাইটি-এই তিনটি ম্যাচ পাতানো ছিল বলে অভিযোগ। ২০১১ সালে ম্যাচ পাতিয়ে ২০ লাখ টাকা জরিমানা গুনেছিল শেখ জামাল, রহমতগঞ্জ দিয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়াও আছে অনেক অভিযোগ, প্রমাণের ঘটনা।
“এই ধাপগুলোতে টুর্নামেন্টের শেষ দিকে, যখন চ্যাম্পিয়ন হওয়া বা রেলিগেশন থেকে বাঁচার ব্যাপার আসে, সাধারণত তখন পাতানো ম্যাচ বেশি হয়। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে অনেকগুলো দল থাকলে, যারা পরের ধাপে যেতে চায়, তারা এগুলো বেশি করে। আবার এমনও হয়, আগেভাগে নিজেদের সেরা হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেলে নিচের দিকের দলের যাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তাদের অবনমন বাঁচাতে কেউ কেউ ম্যাচ ছেড়ে দেয়।”
“বিষয়টা তো এক পক্ষের না। অনেকে আছে, লিগের শুরু থেকেই পাতানো খেলা শুরু করে। এরা ফুটবলের ক্যান্সার। ফুটবলকে শেষ করে দেয়। এর প্রভাব পড়ে উঠতি ছেলে-পেলেদের ওপর। তারাও এটা অল্প বয়সে শিখে ফেলে। এ ধাপে অধিকাংশ খেলোয়াড়রই আসে গরীব পরিবার থেকে। কখনও কখনও ক্লাবের চাপে, কোচদের কথায় কিংবা টাকার লোভে ছেলেরা এই ফাঁদে পা দেয়। ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলে।”
প্রয়োজন আর্থিক সঙ্কটের সমাধান, সঠিক পরিকল্পনা
খেলা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ১৯৮০ সালে শুরু করেন কোচিং রেজাউল। ১৯৯৪ সাল থেকে শুধু কোচিং। সবশেষ কোচ ছিলেন দ্বিতীয় বিভাগের দল প্রান্তিক ক্রীড়া চক্রের। কোনো লাইসেন্স না করা ৫৬ বছর বয়সী এই কোচ এ বছর হাল ধরবেন বিসিএলের দল টিঅ্যান্ডটির।
নিজের ডাকনামে ‘তোতা ফুটবল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। দলটি খেলে পাইওনিয়ার লিগে। সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী ও সাবেক জাতীয় অধিনায়ক আরিফ খান জয়, কোচ মারুফুল ইসলাম, সৈয়দ গোলাম জিলানী, কামাল বাবুসহ আরও অনেক খেলোয়াড়, সুহৃদের সহযোগিতায় একাডেমির কার্যক্রম চলছে বলে জানালেন তিনি।
আর্থিক সঙ্কটই এই ধাপগুলোর সব সমস্যার মূল বলে বলে মনে করেন রেজাউল। এই সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি পাতানো ম্যাচের শেকড় সমূলে উৎপাটনে বাফুফেকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার আহ্বান তার।
“যে দেশে প্রধানমন্ত্রী ফুটবল ভালোবাসেন, সে দেশে ফুটবল হবে না, এটা কোনো কথা হলো? এই ধাপে (পাইওনিয়ার থেকে বিসিএল) হীরা আছে। কিন্তু আমরা গড়তে পারি না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা টাকা-পয়সার।”
“সঠিক পরিকল্পনার অভাব। সবারই দায় আছে কম-বেশি। এই সমস্যাগুলো না থাকলে পাতানো ম্যাচ থেকে শুরু করে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এটা বন্ধে বাফুফেকে আরও কঠোর হওয়া দরকার। সচেতন হওয়া দরকার আমাদেরও।”
কঠোর হবে বাফুফে
পাতানো ম্যাচের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দলগুলোই মূলত অভিযোগ করে। ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চেপে যান অনেকে। কিছু অভিযোগ, সন্দেহ উঠে আসে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উল্লেখ করে জানালেন পাতানো ম্যাচ রোধে কাজ করার কথা।
“প্রতিবছর গড়ে সাত-আটটি ম্যাচ নিয়ে অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। এছাড়া আমরা নিজেরাও স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু ম্যাচ, বিশেষ করে যেগুলো আমাদের কাছে সন্দেহের মনে হয় বা গণমাধ্যমে যে ম্যাচগুলো নিয়ে খবর আসে, সেগুলো খতিয়ে দেখি। চেষ্টা করি সবগুলো ম্যাচের ভিডিও রাখার। যথাযথ প্রমাণ পেলে শাস্তিও দেই।”
“বাফুফের কঠোরতা এবং তৎপরতার কারণে অতীতের চেয়ে বর্তমানে এই ধরনের কর্মকাণ্ড অনেক কমে এসেছে। প্রযুক্তিগত এবং আরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে আমাদের। তারপরও পাতানো ম্যাচ পুরোপরি রোধে বাফুফে বদ্ধপরিকর।”