খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানার পরও ভালো-মন্দ মিলিয়ে অদ্ভূত সব কাজের জন্য বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন মারাদোনা। ১৯৮৬ সালে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো তারকা এই ফুটবলারকে অবসর জীবনে অনুশোচনায় ভুগতেও দেখা গেছে। ফুটবল বিশ্বকে হতবাক করে দেওয়া তার কিছু স্বীকারোক্তিই যার প্রমাণ।
মাদক সমস্যা
মাদক তার খেলোয়াড়ী জীবনকে যেমন বারবার বাধার মুখে ফেলেছে, তেমনি তাড়িয়ে বেরিয়েছে পরবর্তী জীবনেও। কয়েক মাস আগে আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেল টিওয়াইসি স্পোর্টসকে তিনি বলেন, “আমার কিছুই ছিল না, আমি ছিলাম এক জীবন্ত লাশ।”
পূর্বের নানা কষ্টের কথা স্মরণ করে ১৯৯৬ সালে ইতালির জেন্তে ম্যাগাজিনকে মারাদোনা বলেছিলেন, “ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে আমি মাদক নিয়েছিলাম, তবে তা শক্তি বাড়ানোর জন্য নয়। যারা বলে, কোকেইন মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, তারা কিছুই জানে না। আপনি যদি ফুটবল খেলার জন্য কোকেইন নেন, তাহলে খেলতে পারবেন না।”
“মাঠে থাকার জন্য এটা ভালো নয়। এটা জীবনের কোনো কাজে আসে না। কিছুই না।”
২০০৬ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও পুরনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলেছিলেন মারাদোনা। যেখানে প্রথম অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি।
“১৯৮২ সালে ইউরোপে আমি প্রথম মাদক নিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ২২ বছর…মাদক নিয়েছিলাম কারণ তখন ফুটবল দুনিয়ার সব জায়গাতেই এটা ছিল।”
“আলো বন্ধ করে আমি বাথরুমে যেতাম (মাদক নিতে)। একদিন আমি যখন বাথরুমে ছিলাম, দালমা (মারাদোনার মেয়ে) হঠাৎ দরজায় নক করল-আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আমি মাদকাসক্ত ছিলাম। আমি মাদকাসক্ত এবং সবার চোখে আমি সবসময় মাদকাসক্ত থাকব। কারণ মাদকাসক্তকে কখনো কোনোকিছুর জন্যই ক্ষমা করা হয় না।”
সাংবাদিকের দিকে রাইফেল তাক
সাংবাদিকদের সঙ্গে সবসময় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তেন মারাদোনা, যেমনটা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের মাঝপথে মাদক নিয়ে ধরা পড়ার আগে; নিজের বাড়ির দরজায় সাংবাদিকের দিকে রাইফেল নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন।
আরেকবার, ২০১৩ সালে সাংবাদিকদের দিকে পাথর ছুড়ে মারেন মারাদোনা, লাথিও মেরেছিলেন।
ওই ঘটনা প্রসঙ্গে এক ফটোগ্রাফার স্প্যানিশ পত্রিকা মুন্দো দেপোর্তিভোকে বলেছিলেন, “আমরা ছবি তুলছিলাম, তখন তিনি আমাদের অপমান করা শুরু করেন। কিন্তু আমরা ছবি তুলতে থাকি, তখন তিনি পাথর ছুড়ে মারছিলেন আমাদের দিকে। এসে তিনি আমাদের এক সহকর্মীকে লাথি মারেন।”
ফুটবল মাঠে লড়াই
বার্সেলোনায় দুই মৌসুম খেলেছিলেন মারাদোনা। শেষটা যদিও আশানুরূপ ছিল না। ১৯৮৪ সালের কোপা দেল রের ফাইনালে প্রতিপক্ষ আথলেতিক বিলবাওয়ের মিগুয়েল আনহেল সোলার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন মারাদোনা। এরপরই অবশ্য চলে যান ইতালির দল নাপোলিতে।
নিজের এক বান্ধবীর সঙ্গেও সমস্যায় জড়িয়েছিলেন মারাদোনা। তার প্রেমিকা রোসিও অলিভিয়ার গায়ে হাত তোলার অভিযোগে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
সবার বিপক্ষে মারাদোনা
বরাবরই তিনি ভীষণ ঠোঁটকাটা স্বভাবের। কারো সম্পর্কে কখনোই কিছু বলতে পিছপা হন না, যা ভাবেন তাই বলে দেন। তাতে তৈরি হয় বিতর্ক। এজন্যও তাকে বারবার সমালোচনা শুনতে হয়েছে।
উত্তরসূরি লিওনেল মেসির প্রশংসায় সবসময় পঞ্চমুখ মারাদোনা। তবে সাবেক শিষ্যর সম্পর্কে একবার বলে বসেন ভীষণ কড়া কথা; প্রশ্ন তুলেছিলেন বার্সেলোনা তারকার নেতৃত্ব নিয়ে।
“কোনো ম্যাচের আগে যে ২০ বার বাথরুমে যায়, তাকে অধিনায়কত্ব দেওয়ার কোনো মানে নেই।”
অনেকের মতে, সময়ের সেরা ফুটবলার মেসি। কেউ কেউ তো তাকে ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের তকমা দিতেও কার্পণ্য করেন না। মারাদোনার মত অবশ্য ভিন্ন।
“দলে মেসির কদর নিয়ে কারো কোনো দ্বিধা নেই। তবে নিশ্চিতভাবে সে সবার সেরা নয়।”
সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর প্রসঙ্গে একবার এক বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন।
“ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো একটি গোল করে এবং আপনার কাছে শ্যাম্পু বিক্রি করে।”
মেসি বনাম রোনালদো
বর্তমানের সেরা ফুটবলার কে? মেসি নাকি রোনালদো? ফুটবল জগতে গত এক দশকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বুঝি এটি। এ প্রসঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে মারাদোনা মেসির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।
“ক্রিস্তিয়ানো আর্জেন্টাইন হলে খুশি হতাম। কিন্তু তার মতো একজন আমাদের ছিল-গাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। মেসিকে আমি বেশি পছন্দ করি।”
বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও মাঝে মধ্যে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে বসেন মারাদোনা।
“জর্জ বুশ (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট) একজন খুনি। আমি ফিদেল কাস্ত্রোর (কিউবার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান) বন্ধু হতে পছন্দ করব।”
“ডনাল্ড ট্রাম্প একটা পুতুল।”
পেলের সম্পর্কে
কারো মতে, পেলে ইতিহাসের সেরা ফুটবলার। কেউ আবার বেছে নেন মারাদোনাকে। কিংবদন্তি দুজনই; তাদের মাঝে সম্পর্কটা যদিও কখনোই তেমন ভালো ছিল না। পেলের সম্পর্কে মারাদোনার কিছু মন্তব্যই যার প্রমাণ।
“পেলেকে যাদুঘরে ফিরে যেতে বলুন।”
“নেইমার মেসির চেয়ে ভালো?-পেলে ভুল ঔষধ খেয়ে ফেলেছে।”
“আপনার সিদ্ধান্তের ওপর বয়স প্রভাব ফেলছে। ২০ বছর ধরে পেলে কিছুই করেনি। এমনকি তাকে সুপারমার্কেটেও দেখা যায় না। সে শুধু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফিফা সভাপতির পেছনে একটা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।”
আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) সমালোচনা করে অনেকবার আলোচনায় এসেছেন মারাদোনা। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফার সাবেক প্রধান জেপ ব্লাটারকে মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি।
“এএফএ-তে গ্রেনেড ছোড়া উচিত এবং সবকিছু নতুন করে শুরু করা উচিত।”
“(আর্জেন্টিনা জাতীয় দল নিয়ে) আমি অনেক কিছু করতে চাই। কিন্তু জাতীয় দলের চারিদিকে অনেক বিশ্বাসঘাতক আছে।”
হ্যান্ড অব গড
১৯৮৬ বিশ্বকাপের নায়ক নিশ্চিতভাবে মারাদোনা। তবে ইংল্যান্ডের কাছে তিনি ‘খলনায়ক’ হয়েই থাকবেন। মেক্সিকোর ওই আসরের কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে লাফিয়ে হাতের ফ্লিকে পরাস্ত করেছিলেন মারাদোনা। গোলটি ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে খ্যাত। পরে অবশ্য পায়ের জাদুতে করেছিলেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল। ২-১ গোলে জেতে আর্জেন্টিনা। ওই আসরেই পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপার স্বাদ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা।
পরবর্তীতে অনেক সাক্ষাৎকারেই গোলটি নিয়ে কথা বলেছিলেন মারাদোনা।
শিলটনকে উদ্দেশ করে একবার বলেন, “শিলটন, আমি তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই-গোলটি আমি হাত দিয়ে করেছিলাম।”
২০১৭ সালে তিনি বলেন, “আমি এটা নিয়ে ভেবেছিলাম এবং নিশ্চিত যে, যদি প্রযুক্তির ব্যবহার থাকত, তাহলে গোলটা হত না।”
সমকামীদের নিয়েও একবার বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছিলেন মারাদোনা।
“আমি সমকামীদের বিপক্ষে কি-না? কখনোই না। তারা থাকায় বরং ভালো। কারণ তারা আমাদের মানে যারা আসল পুরুষ, তাদের জন্য অনেক মেয়ে ছেড়ে দেয়।”