ভারতীয় ফুটবলে কমছে বাঙালি: মোহনবাগান ম্যানেজার

সময়ের ধুলো পড়ে আর বাস্তবতার কষাঘাতে একসময় ঐতিহ্যও মলিন হয়! ভারতের ফুটবলে কলকাতার বাঙালি ফুটবলারদের যে দাপট ছিল, বর্তমানে তার ছিটেফোঁটাও না থাকাটা যেন সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে আসা মোহনবাগানের টিম ম্যানেজার সঞ্জয় ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতীয় ফুটবলে বাঙালিদের দাপট কমে যাওয়া থেকে শুরু করে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের দাপুটে ফুটবল নিয়ে অনেক কথাই বললেন।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরচট্টগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2019, 08:54 AM
Updated : 26 Oct 2019, 09:04 AM

গত ১৫ অক্টোবর কলকাতার সল্ট লেক স্টেডিয়ামে হয় ভারত-বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের ম্যাচ। ওই ম্যাচে ভারতের সেরা একাদশে ছিল না কোনো বাঙালি ফুটবলার! ২৩ জনের দলে গোলরক্ষক সুভাশীষ বোস, ডিফেন্ডার প্রীতম কোটাল ও গলুই সার্থকের বদলি তালিকায় থাকাটা বাঙালিদের ‘টিকে থাকার’ উদাহরণ হয়ে ছিল!

৩০টি কলকাতা লিগ, ১৬টি ডুরান্ড কাপ, ২২টি আইএফএ  শিল্ড, ১৪টি ফেডারেশন কাপ, ১টি আই লিগসহ ১৩০ বছরের পুরানো মোহনবাগানের ট্রফিকেসে আলো ছড়াচ্ছে আরও অনেক শিরোপা। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ে দলটির সেই আধিপত্যে টান পড়েছে। অকপটে সঞ্জয় সব বাস্তবতা তুলে ধরলেন।

কলকাতার ফুটবলেও পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে বিদেশিরা

শেখ কামাল ক্লাব কাপ খেলতে আসা মোহনবাগান দলে স্প্যানিশ ৫ জন। আছে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর খেলোয়াড়ও। দলটির কোচও স্প্যানিশ। সেরা একাদশে বিদেশিদের আধিপত্যের প্রসঙ্গ পাড়তে সঞ্জয় জানালেন কলকাতার ফুটবলও নির্ভর হয়ে পড়ছে বিদেশিতে।

“আমাদের দলে সব বিদেশিকে এই মৌসুমের জন্যই আনা। কোচও (হোসে আন্তোনিও) স্প্যানিশ। তার পরামর্শ মতোই সব আনা হয়েছে। এটা স্প্যানিশ ফ্লেভার তিকিতাকা আনার ব্যাপার নয়। আমাদের কমিটি এই কোচকে যোগ্য মনে করেছে, এনেছে। বিদেশি খেলোয়াড়ও উনার পছন্দ অনুযায়ী আনা হয়েছে।”

“এখন দলগুলোয় অনেক বিদেশি, তারা পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। গতবার চেন্নাই সিটি আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওদের চার-পাঁচজন বিদেশির ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে সনি নর্দে যাওয়ার পরই আমরা আই লিগটা জিতেছিলাম। এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারত বলুন, বাংলাদেশ বলুন-সবখানেই বিদেশিরা পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। বাঙালিদের আধিপত্য একটুখানি কমেছে।”

পাইপলাইনে বাঙালি ফুটবলার নেই

কলকাতার দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল। দুই দলেই বাঙালি খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমছে। ডার্বি, সমর্থকদের লড়াই নিয়ে বলতে গিয়ে সঞ্জয় জানালেন, কলকাতার বাঙালিরা এখন ঝুঁকছে ক্রিকেটের দিকে। টানলেন বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের উদাহরণও।

“ফুটবলে বাঙালি ছেলেরা কম আসছে। এটা ক্রিকেটের দাপটে। বাবা-মা চাইছে কোনোভাবে শিকে ছিঁড়ে ছেলে যদি সৌরভ গাঙ্গুলী হতে পারে, তাহলে তার আর কোনো চিন্তা নেই। আগে গ্রামে ৪/৫ জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফুটবল খেলত। সেখান থেকে ফুটবলার উঠে আসত, সেটা কমে গেছে।”

“এটা কিন্তু অন্য কোনো কারণে নয়, সামাজিক প্রেক্ষিতে কমে গেছে। ক্রিকেটের যে দাপট, পয়সা, গ্ল্যামার সেটা একটু হলেও নতুন প্রজন্মকে….আপনি কলকাতার কোনো ‍ক্রিকেট একাডেমিতে গেলেও দেখবেন ভিড়। আমাদের দলে তো ৮/১০ জন বাঙালি আছে। ইষ্টবেঙ্গলে আরও কম।”

“আজকে প্রতিটি পরিবারের লক্ষ্য তার ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে, বাংলা মিডিয়ামে ছাত্র কমছে কেনো? ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালে একটা ভালো চাকরি-নিশ্চিত এই ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে তারা।”

জীর্ণতার মধ্যে সম্বল সমর্থকদের দাপট

ফেইসবুককেন্দ্রীক একটা সমর্থকগোষ্ঠীও এখন আছে কলকাতার ফুটবলে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি উপভোগ করতে যারা এখন গ্যালারিতে আসার চেয়ে ফেইসবুকে তোপ দাগাতে পছন্দ করে বলেও জানালেন ২০১২ সাল থেকে টিম ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা সঞ্জয়।

“আই লিগ, আইএসএল  মিলিয়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো কোনো ফ্যানবেইজ ক্লাব ভারতবর্ষে নেই। মোহনবাগানের সমর্থক গোষ্ঠী এশিয়ার যে কোনো দলের কাছে হিংসার বিষয়। সমর্থকদের লড়াইটা এখন নতুন প্রজন্মের কাছে যতটা মাঠে গিয়ে করা, পাথর ছোঁড়ার চেয়ে বেশি ফেইসবুক কেন্দ্রীক হয়ে গেছে।”

“ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ফ্যানবেইজের যে আধিপত্য, সেটা রয়ে গেছে। কলকাতার ডার্বি হলে গ্যালারিতে যে উন্মাদনা তৈরি হয়, এটা ভারতবর্ষে কোথাও নেই।”

“২০১৪-১৫ মৌসুমে আমরা আই লিগ পেয়েছি। ওরা এখনও পাইনি। এটা নিয়ে আমাদের ভেতরে একটা ইয়ে (ভালো লাগা) আছে। কিন্তু এটা মানতে হবে ইস্টবেঙ্গল না থাকলে মোহনবাগান থাকত না। মোহনবাগান না থাকলে ইস্টবেঙ্গল থাকত না। আমরা যদি মনে করি ইস্টবেঙ্গল শেষ হয়ে গেছে, তাহলে সেটা মোহনবাগানের জন্য ভালো না।”

আইএসএল  কোনো তারকা তৈরি করেনি

২০১৪ সালে শুরু হওয়া ইন্ডিয়ান সুপার লিগ আইএসএলে কলকাতার দল আতলেতিকো ডি কলকাতা দুইবার চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এই টুর্নামেন্টে এখনও অংশই নেয়নি! বিত্ত আর গ্ল্যামারে ঠাসা আইএসএল  নিয়ে যেন একটু উষ্মাই জানালেন সঞ্জয়। আইএসএলের চেয়ে বরং আই লিগকে এগিয়ে রাখলেন তিনি।

“আই লিগ চলার পর কলকাতার আধিপত্য কিছুটা খর্ব হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তিন-চার বছর আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ মিস করেছি। একবার আইজল এফসি চ্যাম্পিয়ন হলো। মিনেরভা পাঞ্জাব হলো। ফুটবলটা ছড়িয়েছে অনেক জায়গায়। পাঞ্জাবের তো ফুটবলের ঐতিহ্য ছিল। পাহাড় থেকেও একটা দল এসেছে।”

“ভারতের র‌্যাঙ্কিংয়ের উন্নতিতে আইএসএলের কোনো অবদান নেই। আপনি দেখান আইএসএল  একটা খেলোয়াড় তৈরি করেছে। একটা খেলোয়াড়ের নাম বলুন। সব গেছে আই লিগ থেকে। ভালো মানের বিদেশি আইএসএলে খুব বেশি নেই। এবারেরগুলো সম্পর্কে অবশ্য জানি না।”

“কাগজ কলমে আইএসএলের চাকচিক্য আছে। সেটাও কিন্তু কমছে। আগে ওরা ফাইভস্টার হোটেলে রাখত সব খেলোয়াড়কে। এবার বিদেশিদের হোটেলে রাখছে। কিন্তু দেশিদের একটা টাকা দিয়ে বলছে একটা জায়গায় থাকো।”

“(টিকে থাকার জন্য) আমরাও হয়ত আগামী আইএসএলে খেলব…যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। কারণ আইএসএলেরও মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে দরকার। আইএসএল হচ্ছে কিন্তু ওদের গেট সেল কিছু নেই। আমরা এএফসির কাছে এর একটা রোড়ম্যাপ চেয়েছিলাম। তারা দিয়েছে।

সল্ট লেকে বাংলাদেশ জিততে পারত

গত ১৫ অক্টোবরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সল্ট লেকে শুরুতে এগিয়ে গিয়েও ভারতের সঙ্গে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। ম্যাচটি বাংলাদেশ জিততে পারত বলেও মনে করেন সঞ্জয়। আরও জানালেন সুনীল ছেত্রী-আশিক কুরুনিয়ানরা দর্শকের চাপটা নিতে পারেনি।

“সল্ট লেকে ভালো খেলেছিল বাংলাদেশ। শুরুতেই তো ওরা এগিয়ে গেলো। শেষে গোল খেয়েছে। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিততে পারত। আমার মনে হয় ভারত দর্শকের চাপ নিতে পারেনি।”

“এই যে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ হলো, টিকেট বিক্রি, টিকেট কালোবাজারী, এত দর্শক, উন্মাদনা-এতটা রঙ ভারতবর্ষের অন্য কোথাও নেই।”