একটু কি ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেলো? টান পড়ে গেলো এতদিনের সম্পর্কের সুতোঁয়? গত অগাস্টে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করেছে ঘটা করে। ক্লাবের আঙিনায় বসেছিল সাবেক, বর্তমানদের মিলনমেলা। প্রাণের টানে অনেকে উড়ে এসেছিলেন বিদেশ-বিভুঁই থেকে। বেঁচে থাকলে হয়ত উড়ে আসতেন মোনেম মুন্নাও! আড্ডা জমাতেন,রোমন্থন করতেন কলকাতা রাঙানোর স্মৃতি। কিন্তু সেই ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন মুন্না। ইস্ট বেঙ্গলের জমকালো আয়োজনে আমন্ত্রণ মেলেনি তার পরিবারের কারও! মুন্নার স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে জানা গেল ক্লাবটির ইতিহাস, পথচলা, টিকে থাকার অনেক গল্প।
Published : 15 Oct 2019, 08:59 PM
বাংলাদেশের ফুটবল আকাশে উজ্জ্বল তারাগুলোর একটি মুন্না। অকালে ঝরে যাওয়া তারাদের একটিও। কিডনি জটিলতায় মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ওপারে পাড়ি দেওয়া এই ফুটবলার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে ছড়িয়েছিলেন আলো। খেলেছিলেন মাত্র দুটি মৌসুম। জিতেছিলেন দুটি লিগ শিরোপা, ফেডারেশন কাপ এবং লাল-হলুদ সমর্থকদের মনও। কলকাতায় পেয়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয়তা।
মুন্নাকে মনে আছে, ওরাও পাবে আমন্ত্রণ
আমন্ত্রণ না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কষ্ট পেয়েছিলেন মুন্নার স্ত্রী সুরভী মোনেম মুন্না। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন। দেখেছিলেন মুন্নার জনপ্রিয়তা। একারণেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হতাশার কথাটা জানিয়েছিলেন।
“ফেইসবুকে কেউ একজনের পোস্ট দেখে জেনেছি ইস্ট বেঙ্গল এত বড় আয়োজন করছে। আমি একটু হতাশই হয়েছি, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমন্ত্রণ জানায়নি। অথচ মুন্না ওদের হয়ে হৃদয় দিয়ে খেলত। ক্লাবের সমর্থকরা ওকে ভীষণ ভালোবাসত।”
“একশ বছর উদযাপন করছি আমরা। বাংলাদেশ থেকেও পুরানো খেলোয়াড়, সমর্থকদের ভালো সাড়া পেয়েছি। রিজভি আহমেদ রুমি, শেখ মোহাম্মদ আসলাম (ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন), সংগঠক হারুনুর রশিদ ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। মুন্নার পরিবারের সঙ্গে আমরা এখনও যোগাযোগ করতে পারিনি। আমাদের এই আয়োজন ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত চলবে। এর মধ্যে আমরা ওর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করব, তাদেরকেও আনব। আমরা ওকে ভুলিনি।”
মঙ্গলবার সকালে ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, পুজোর ছুটির রেশ এখনও কাটেনি। ক্লাব বেশ ফাঁকা। গুটি কয়েক কর্মচারী গোছগাছ সারছে। কফি রুমের এক কোণে আয়েশি ভঙ্গীতে বসে থাকা ষষ্ঠী দুলের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো শতবর্ষ পূর্তি আয়োজন, মুন্নাসহ আরও অনেক বিষয়। ক্লাবটির স্কুল ফুটবলের কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত ভারতের এই সাবেক মিডফিল্ডারও জানালেন, অগাস্টের ওই আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মূলত অধিনায়কদের।
“বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধির অংশগ্রহণ ছিল কিনা বলতে পারব না। কিন্তু যদি ক্যাপ্টেন হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিত তাকে ডেকেছিল। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের কেউ ইস্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন ছিল। যেমন সুলে মুসা নাইজেরিয়া থাকে, সেখান থেকে তাকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। কোনো অধিনায়ক যদি বেঁচে না থাকে, তাহলে তার স্ত্রী বা সন্তানকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।”
“অনেক ক্লাব আছে যেখানে খেলে কেউ চলে গেছে, ক্লাবও তাদের ভুলে গেছে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কখনও ভুলে যায় না। তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, সম্মাননা দেওয়া, ভারত বর্ষে আর কোনো ক্লাব দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই।”
কদিন আগেই জি বাংলা ফুটবল লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ে হরহামেশাই যা হয়, হলোও তাই। পেনাল্টি সিদ্বান্ত নিয়ে বেঁধে গেলো লঙ্কাকাণ্ড। শেষ পর্যন্ত আর খেলাই হয়নি। যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে আয়োজকরা। ট্রফি রুমে সাজানো হাজারো অর্জনের মধ্যে দেখা গেলো সেটিও। তবে দুলের দাবি, ডার্বির উন্মাদনা থাকলেও সার্বিকভাবে কমছে কলকাতার ফুটবলের মান।
“দুই দলের সমর্থকদের আবেগ কিন্তু একই আছে। সেটা কমেনি। বরং বেড়েছে। ডার্বি ম্যাচগুলো হলেই আপনি বুঝতে পারবেন। কিন্তু ফুটবলের মান কমেছে। সাপ্লাই লাইন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে যে খেলোয়াড় উঠে আসত, সেটা কমেছে। সেটা রাজনৈতিক কারণে হতে পারে। ”
“কলকাতার ফুটবল আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে যেমন ইনডিভিজ্যুয়াল স্কিলের ফুটবলার ছিল কৃষানু দে, বিকাশ মাঝি, শিশির ঘোষ-এমন আরও অনেকে, কত বড় বড় খেলোয়াড় ছিল। এখন নেই।”
ইস্টবেঙ্গলের ট্রফি রুমে আলো ছড়াচ্ছে আইএফএ শিল্ডের ২৮টি শিরোপা, কলকাতা ফুটবল লিগের ৩২টি, ফেডারেশন কাপের ৮টি, ১৬টি দেরাদুন কাপ, ১০টি রোভার্স কাপসহ আরও কত-শত ট্রফি। কিন্তু আজও জিততে পারেনি ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া ভারতের শীর্ষ লিগ, আই লিগের শিরোপা। গতবারসহ মোট চারবার রানার্সআপ হয়েছে তারা। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান আই লিগ জিতেছে ২০১৪-১৫ মৌসুমে। ইস্টবেঙ্গল তো বটেই, কলকাতার ফুটবলের মান কমে যাওয়ার উদাহরণও দিলেন দুলে।
“আগে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের জার্সি পরতে হলে কত কিছু করতে হতো। এখন এগুলো লাগে না। আগে খেলোয়াড়দের ডেডিকেশন ছিল। এখন নেই। এই আসছি-যাচ্ছি-খেলছি বিষয়টা এরকম। এখন ইস্ট বেঙ্গলে খেলে, কিন্তু সেই ছেলেটাকে কেউ ওভাবে চেনেই না!”
“দেখুন, ভারতীয় দলে এখন মোটে একজন বাঙালি খেলোয়াড়। আগে ভারতীয় দল তৈরি হলে ১২ জনের মধ্যে ১০-১১ জন বাঙালি থাকত। কখনও তো ১২ জনই থাকত। এটা হওয়ার কারণ খেলোয়াড় সাপ্লাই নেই। গ্রাম-গঞ্জে খেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ দিকে নজর না দিয়ে বেরিয়ে আসার উপায় নেই। বাংলার ফুটবল উপরে নিয়ে যাওয়া কঠিন।”
বাণিজ্যের বাজার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট। তারপরও ইস্টবেঙ্গল টিকে আছে। চলছে স্কুল ফুটবল কোচিং। আছে ১৩, ১৫ ও ১৮ বছর বয়সীদের দল। সিনিয়র দলের বড় একটা অংশ আসে বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে। টাকা-পয়সার টানাপোড়েনও নেই পেশাদার কাঠামোর কারণে। মাঠ, আবাসন, জিমনেশিয়াম থেকে শুরু করে একটি আদর্শ ক্লাবের যা যা থাকার কথা, প্রায় সবই ইস্টবেঙ্গলে আছে বলেন জানালেন দুলে। চারপাশে ঘুরে সেসবের প্রমাণও মিলল। যেসব বাংলাদেশের ক্লাবগুলোতে কিঞ্চিৎ মেলে বা একেবারেই মেলে না।
“৫ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের নিয়ে হয় স্কুল ফুটবল কোচিং। শিক্ষার্থীরা ১০ বছরের উপরে হলে ১৫০০, নিচে হলে ১০০০ হাজার রুপি দেয়। অনূর্ধ্ব ১৩, ১৫, ১৮ দলের সারাবছর ট্রেনিং চলে। গ্রাম থেকে আসা অনেকে, যাদের থাকার জায়গা নেই, তাদের এখানে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়।”
“১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের ক্লাবে থাকতে হবে, কোথাও যেতে পারবে না। এরপর তারা যেকোনো ক্লাবে চলে যেতে পারে। ইচ্ছে করলে সিনিয়র টিমে যোগ দিতে পারে। কেউ যদি এই ক্লাবে থেকে যেতে চায় তখন ক্লাব কিছু সুবিধা পায়। বয়সভিত্তিক গ্রুপের সুবিধা ইস্ট বেঙ্গল পাচ্ছে। এবার যেমন ৮-১০ জন খেলোয়াড় সিনিয়র টিমে যোগ দিয়েছে।”
এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য দেবব্রত জানালেন মার্কেটিং পলিসি থেকে শুরু করে সাংগঠিক ব্যাপারগুলো, “স্পন্সর, ইনভেস্টর ও ডোনেশনের উপর চলে ক্লাব। আমাদের মার্কেটিং উইংয়ের মাধ্যমে টি শার্ট কফি মগ, ব্রেসলেট, এসব বিভিন্ন খাত থেকে টাকা আসে। চারিদিক থেকে যেটা আসছে, আমাদের ভালোই চলছে। লিগে আমরা সবসময় তিন-চারে থাকি এটাই, স্পন্সরদের আকৃষ্ট করে যথেষ্ট।”