বাংলাদেশের স্মৃতি দোলা দেয় হামজাকে

জন্ম, বেড়ে ওঠা, ফুটবলে হাতেখড়ি থেকে শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা-সবই ইংল্যান্ডের মাটিতে। তবে বাংলাদেশের মাটির ছোঁয়ার শিহরণও ভুলতে পারেন না হামজা চৌধুরী। তার মনের কোণে আজও দোলা দেয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে কাটানো কিছু সুখস্মৃতি। ছোট্টবেলায় ছুটি কাটাতে আসতেন তিনি লাল-সবুজের দেশে। বাঁধনহারা সেই দিনগুলির রোমাঞ্চকর অনুভূতি এখনও নাড়া দেয় লেস্টার সিটির প্রতিশ্রুতিশীল এই ফুটবলারকে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2019, 12:25 PM
Updated : 5 Oct 2019, 02:16 PM

বিবিসিকে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে নিজের সেই ছেলেবেলা, ফুটবলের পথে চলা শুরু থেকে লেস্টার সিটিকে ভালোবেসে ফেলা, সবই তুলে ধরলেন বাংলাদেশ-গ্রেনাডিয়ান বংশোদ্ভূত হামজা দেওয়ান চৌধুরী।

ফুটবলে হামজার সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে এবং তা বাস্তবে মেলে ধরতে পাঁচ বছর বয়সে তাকে ফুটবলে কোচিং শুরু করান তার মা রাফিয়া। মায়ের দেখানো পথে হেঁটে হামজা আজ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ চারের জন্য লড়াই করা লেস্টার সিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিডফিল্ডার।

হামজার ছোট্টবেলার দুটি বিষয় আজও উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান: এক, ফুটবল মেধা, লেস্টারের মাঝমাঠের ফুটবলে বল পায়ে তার কারিকুরি ও আক্রমণভাগে সতীর্থদের বুদ্ধিদীপ্ত পাস দেওয়ার মাঝে যা ফুটে ওঠে। দুই, চুল কাটানো আজও যে তার বড্ড অপছন্দ, মাথার ঝাঁকড়া চুল দেখলেই বোঝা যায়।

লেস্টার সিটির অনুশীলন মাঠে বসে পেছনে ফিরে তাকালেন হামজা। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনলেন ফেলে আসা সেই দিনগুলিকে।

"আমি চুল কাটাতে অপছন্দ করি। যখন ছোট ছিলাম মা আমাকে চুল কাটাতে জোর করতো। আমি এটিকে বাড়তে দিয়েছি।"

"লাফবরো ইউনিভার্সিটিতে ফুটবল ওপেন ডেতে তিনিই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মা হয়তো চেয়েছিলেন, আমার কিছু শক্তি ক্ষয় হোক। কারণ আমি অনেক ছুটোছুটি করতাম। নতুন ও ভিন্ন কিছু করতে কখনোই তার আপত্তি নেই। সেবারই আমি প্রথম ফুটবল খেলতে পেরেছিলাম। সেই শুরু।"

দুই বছর পর আঙ্কেল ফারুকের সঙ্গে প্রথমবারের মতো লেস্টার সিটির ঘরের মাঠে ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন হামজা। সেদিনের সাত বছর বয়সী হামজা কী কল্পনা করেছিলেন, এক দিন তিনি লেস্টারের জার্সি পরে মাঠ মাতাবেন! আজকের ২২ বছর বয়সী হামজার কাছে, ‘এটা একটা স্বপ্ন!’ 

ছবি: ইন্সটাগ্রাম

হামজার ছেলেবেলা

স্মৃতির মেলায় পেছন ফিরে তাকিয়ে হামজা চলে গেলেন ছেলেবেলায়। সেই সময়টা কেটেছে হৈ-হুল্লোড়ে। তার কাজিনরা পার্কে খেলতে আসতো, ভিডিও গেমসে আঙুল চলত সমানে। খেতেও ভালোবাসতেন হামজা এবং সবসময় তার পছন্দের কিছু খাবার থাকতো।

পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতে পারেন হামজা। স্কুল ছুটির সময় পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে নানির বাড়ি বেড়াতে আসতেন হামজা। ছুটি শেষেও সেই দিনগুলোর স্মৃতি তার মনে গেঁথে থাকতো অনেক দিন।

"আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি আছে বাংলাদেশে। ওখানে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম। রাত ১০টায়ও বাচ্চারা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন গোটা পৃথিবীকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই… একদম মুক্ত ও পুরোপুরি নিরাপদ।"

"আমাকে বাংলায় কথা বলতে দেখে লোকে নিশ্চয়ই অবাক হতো...আমরা দুই বছর পর পর সেখানে যেতাম দুই তিন সপ্তাহের জন্য-দারুণ সময় ছিল। খুব বিশেষ কিছু।"

"এটা আমার উত্তরাধিকার, এটিই আমার সংস্কৃতি। ফিরে যাওয়াটা দারুণ কিছু। এসব একটি শিশুকে আরও বিনয়ী করে তোলে এবং দুনিয়ার নানা প্রান্ত দেখার সুযোগ করে দেয়, কারণ ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠা মানে অনেক কিছু নিয়েই ধন্দে থাকতে হতে পারে।”

স্কুলজীবনে ইতিহাস ও অংক বেশ উপভোগ করতেন হামজা। স্কুলের পড়ালেখা অবশ্য তার ফুটবল চর্চায় কিছু ব্যাঘাত ঘটাতো। তবে সেটুকুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি।  

ফুটবলের প্রতি হামজার আবেগ দেখে উৎসাহ দিতেন শিক্ষকদের কয়েকজন। কেউ কেউ আবার বলতেন, বিকল্প একটি পরিকল্পনাও করে রাখা প্রয়োজন। ‘তারা ঠিক কথাই বলতেন’, আজ ফুটবলার হয়ে উঠলেও শিক্ষকদের সেই ভাবনার সঙ্গে একমত হামজা।

ছবি: ইন্সটাগ্রাম

বিশ্বাস, পরিবার ও ফুটবল

হামজার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা জুড়ে আছে ইসলাম ধর্ম। তবে ফুটবল কখনও খুব একটা পেছনে ছিল না।

"আমি ও আমার ছোট বোন মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার স্কুলের পর কুরআন পড়া শিখতে যেতাম।"

বাবা-মা যে তাদেরকে ধর্মশিক্ষা দিয়েছিলেন, তাতে এখন দারুণ খুশি হামজা।

“ছেলেবেলায় মনে হতো, এসব পড়ে সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন আমি খুশি যে আমার বাবা-মা আমাকে এসব করিয়েছেন, নাহলে জরুরি অনেক কিছুর শিক্ষা পাওয়া হতো না। কিন্তু সেই সময় মাথায় থাকত, সব বাদ দিয়ে শুধু খেলতে যেতে হবে।”

"আমি আয়াত আল-কুরসি পড়তে পারি। ড্রেসিং রুম থেকে বের হওয়ার আগে ছোট কিছু দোয়া পড়ি, যা আমার মা আমাকে পড়তে বলতেন।"

লেস্টারের বহু সংস্কৃতির শহরে বেড়ে উঠে তার ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসার পথটা বেশ মসৃণ ছিল বলে নিজেই জানিয়েছেন হামজা। তেমন কোনো কিছুই তাকে সমস্যায় ফেলেনি। বেশ আগের একটা তিক্ত ঘটনার কথা অবশ্য তার মনে পড়ল; শহরের বাইরে একটা ম্যাচে তিনি বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। তবে নিজ দলের কোচের হস্তক্ষেপে দ্রুত সে সমস্যা মিটে গিয়েছিল বলেও জানান হামজা। 

"আমরা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে এটা রিপোর্ট করেছিলাম। আমার মা খুব শক্ত মানসিকতার একজন।  তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে সব পরিস্থিতি সামলাতে হয়।"

প্রেরণাদায়ী হামজা

প্রিমিয়ার লিগে বর্তমানে দুজন দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত ফুটবলার খেলছেন। হামজা ছাড়া আরেকজন অ্যাস্টন ভিলার নিল টেইলর।

ব্রিটিশ-এশিয়ান সমাজে হামজার উঠে আসার গল্প এখন দারুণ সমাদৃত। বিশেষ করে ফুটবল সমর্থকদের কাছে। তাদের সমর্থন পেয়ে খুশি এই মিডফিল্ডার এবং আশা করেন উঠতি ফুটবলাররা তার দেখানো পথ অনুসরণ করবে।

অবশ্য তিনি জানেন যে ইংলিশ লিগগুলোয় খুব বেশি এশিয়ার খেলোয়াড় নেই। তারপরও তিনি ভবিষ্যতের জন্য ভালো সম্ভাবনা দেখছেন।

দীর্ঘ দিন ধরে তার মা, সৎ-বাবা মুর্শিদ ও আঙ্কেল ফারুক যে ত্যাগ স্বীকার করে আসছিলেন, তার ফল মেলে ২০১৭ সালে। লেস্টারের ওই সময়ের কোচ ক্রেইগ শেকসপিয়ার লিগ কাপের ম্যাচে তাকে বদলি হিসেবে নামান। ফুটবলে শীর্ষ পর্যায়ে শুরু হয় হামজার পথচলা।

গত মৌসুমে তার পারফরম্যান্স ছিল নজর কাড়া। বিশেষ করে লেস্টারের ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে ১-১ ড্র ও আর্সেনালের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেন হামজা। এই মৌসুমে খেলেছেন দলের প্রতিটি ম্যাচেই।

এভাবে যদি এগিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে হয়তো দ্রুতই ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের দলে জায়গা করে নিবেন হামজা চৌধুরী।

আর সেটা হলে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাওয়া প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত ফুটবলার হবেন হামজা।

"ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন, চাই মূল দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে। এটি আমার ভাবনায় আছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে এখনই জায়গা আমার প্রাপ্য।  ইংল্যান্ডের হয়ে আমি খেলতে পারি, এটি প্রমাণ করার জন্য আমাকে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, অনেক ম্যাচ খেলতে হবে। খেলতে পারলে, সেটি হবে দারুণ সম্মানের।"