যন্ত্রণা থেকে পরমানন্দ: সাফল্যের চূড়ায় রোনালদো

পুরো পর্তুগাল তার দিকেই তাকিয়ে ছিল; কিন্তু কেবল ২৫ মিনিটই খেললেন তিনি। নিজে কেঁদে আর অনেককে কাঁদিয়ে চোট নিয়ে প্রথমার্ধেই মাঠ ছাড়েন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। তারকা এই ফরোয়ার্ড এদিন আবার কেঁদেছেন। তবে দ্বিতীয়বার তার চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। ফ্রান্সকে হারিয়ে পর্তুগালকে প্রথমবারের মতো ইউরো শিরোপা এনে দিয়েছে যে তার সতীর্থরা। আর তাকে এনে দিয়েছে সত্যিকারের এক ‘গ্রেট’ ফুটবলারের তকমা, যিনি ক্লাব পর্যায়ের মতো এখন আন্তর্জাতিক ফুটবলেও সফল।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2016, 02:40 PM
Updated : 12 July 2016, 12:30 PM

টুর্নামেন্টে খুব বেশি আলো ছড়াতে না পারলেও পর্তুগালকে ফাইনালে তুলতে বড় ভূমিকা রাখেন রোনালদো। স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচেও তিনিই ছিলেন ফের্নান্দো সান্তোসের দলের মূল ভরসা।

ম্যাচের সপ্তম মিনিটে পায়েতের সঙ্গে সংঘর্ষে ব্যথা পান রোনালদো। এরপর দুইবার চোটের পরিচর্যায় মাঠের বাইরে যান আর ফিরে আসেন। দেশের হয়ে প্রথম শিরোপা জেতার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য মাঠে থাকতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২৫তম মিনিটে স্ট্রেচারে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন রিয়াল মাদ্রিদের এই ফরোয়ার্ড।

অনেকেই তখন ভেবেছিলেন রোনালদো বুঝি তার স্বপ্নটাকেও স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেলেন। দলের সেরা তারকাকে ছাড়া পর্তুগাল আর পারবে না বলেই ধরে নিয়েছিল তারা।

শেষ পর্যন্ত রোনালদোর স্বপ্ন পূরণ হলো, আনন্দাশ্রু নিয়ে সাঁ-দেনিতে শিরোপা উঁচিয়ে ধরলেন রোনালদো। অনেকেই বলছেন আসলে পেপে, নানি, এদেররা রোনালদোকে এই উপহার দিয়েছে।

রোনালদো এই ম্যাচে মাত্র ২৫ মিনিটই খেলতে পারেন, কিন্তু মাঠ থেকে ছিটকে গিয়েও তিনি পেপে, নানি, এদেরদের সঙ্গে এমনভাবে ছিলেন যে এটা অনেকাংশেই ছিল রোনালদোর ফাইনাল।

২০০৪ সালে দেশের মাটিতে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছিল পর্তুগাল। সেবার পর্তুগালের শুরুর একাদশে ছিলেন ১৯ বছর বয়সী রোনালদো। গ্রিসের কাছে হেরে শিরোপা স্বপ্ন ভেঙেছিল তাদের। এর পর থেকে অপেক্ষার শুরু রোনালদোর। ঈশ্বরের কাছে আরেকটা সুযোগের জন্য প্রার্থনা করে গেছেন। সেই সুযোগ এলো এবং সেটাকে আলিঙ্গন করে ইতিহাসও গড়লেন তিনি। ভুললেন ১২ বছরের জমানো কষ্ট।

“এটা আমি লম্বা সময় ধরে চেয়ে এসেছি, সেই ২০০৪ থেকে। আমি ঈশ্বরের কাছে আরেকটি সুযোগ দেওয়ার প্রার্থনা করেছিলাম, কারণ এটা আমাদের প্রাপ্য।”

“আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তের একটি এটা, আমি সব সময়ই বলেছি, পর্তুগালের হয়ে কিছু জিততে চাইব আমি। আমার কাছে পর্তুগালের সব মানুষের জন্যই এটা অসাধারণ অনন্য এক মুহূর্ত।”

পর্তুগালকে অনন্য এই মুহূর্ত এনে দিতে রোনালদোর নেতৃত্ব ছিল অসাধারণ। হাঁটুর পরিচর্যা করিয়ে অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরু হওয়ার আগে মাঠে আসেন তিনি। খুঁড়িয়ে হাঁটলেও বেঞ্চে খুব কম সময়ই বসে ছিলেন রোনালদো। পুরো সময়টার জন্য যেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোচ ফের্নান্দো সান্তোসের সহকারী। ডাগআউটে কখনও তার পাশে দাঁড়িয়ে, কখনও তার পেছনে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যান তিনি।

অতিরিক্ত সময়ের খেলার বিরতিতে আলাদা করে প্রত্যেক সতীর্থকে অনুপ্রেরণা দিয়ে আসেন। ১০৮তম মিনিটে যে ফ্রি-কিকে ফ্রান্সের গোলরক্ষক উগো লরিস পরাস্ত হয়েছিলেন, সেটি রাফায়েল গেররেইরোকে নেওয়ার জন্য রোনালদোই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার অসাধারণ কিকে বল লাগে ক্রসবারে। পরের মিনিটেই আসে জয়সূচক গোলটি। বদলি হিসেবে নামা এদেরের প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে নেওয়া আচমকা নিচু শট ঝাঁপিয়ে পড়েও ঠেকাতে পারেননি লরিস।

ম্যাচের একমাত্র গোলটি করা এদের বলেন, “ক্রিস্তিয়ানো আমাকে বলেছে, আমি হয়ত জয়সূচক গোলটি করব। তার সঙ্গে সব সতীর্থরাই এটা বলেছে।”

রোনালদোর সমালোচকরা বরাবরই তার অহংবোধের সমালোচনা করেন। কিন্তু ফাইনালে রোনালদোর আচরণ উদাহরণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন সান্তোস।

“ক্রিস্তিয়ানো অসাধারণ এক উদাহরণ। আজ সে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছিল। ড্রেসিং-রুমে খুব শক্ত ছিল, সে সব ছেলেদেরই সাহায্য করেছে, এটাই টিমওয়ার্কের সংজ্ঞা।”

বিশ্ব জোড়া ফুটবল রোমাঞ্চপিয়সীরা সব সময়ই বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড লিওনেল মেসি আর রোনালদোর তুলনা করে আসছে।

বার্সেলোনার হয়ে ৮টি লিগ ও চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা মেসি দেশের হয়ে এখনও কোনো শিরোপা জেতেননি। কয়েক সপ্তাহ আগে চিলির কাছে কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসরের ফাইনালে হারার পর আন্তর্জাতিক ফুটবলক থেকে অবসর নেন পাঁচবারের বর্ষসেরা ফুটবলার মেসি। সেই ম্যাচে টাইব্রেকারে নিজেদের প্রথম শট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।

রোনালদো তার ক্লাব ক্যারিয়ারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিনটি প্রিমিয়ার লিগ ও একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন। স্পেনের সফলতম ক্লাব রিয়ালের হয়ে জেতেন একটি লিগ শিরোপা আর দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এর সঙ্গে এখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সাফল্যও যোগ হলো তার আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারে।