জীবনের তুলনায় ক্রিকেট কিছুই না: মাশরাফি

মাশরাফি বিন মুর্তজার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এখন গোধূলি বেলা; তবে রাজনীতির ক্যারিয়ারে কেবলই দেখা মিলছে সূর্যোদয়ের রক্তিম আভার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2018, 01:34 PM
Updated : 28 Dec 2018, 04:55 PM

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী ভোটের প্রচারে গত কয়েক দিন চষে বেড়িয়েছেন নির্বাচনী এলাকার অলিগলি। রাজনীতির পাঠশালায় তার হাতেখড়ি হচ্ছে ভোটের মাধ্যমেই।

নির্বাচনী প্রচার শেষ করে বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মাশরাফি শোনালেন তার নতুন অভিজ্ঞার গল্প। কথা বললেন সমকালীন রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, জানালেন স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে এক সুতোয় গাঁথার ভাবনার কথা।

প্রশ্ন: কেমন হল নির্বাচনের ময়দানের অভিজ্ঞতা?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: এটা তো আমার জন্য নতুন জগত। সব বুঝতে সময় লাগবে। মনে হয়েছে লোকে স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছে। অবশ্য নড়াইলে সবাই আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করে, ভালোবাসে। খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই অনেক সমর্থন পেয়েছি। অনেকে আছে শুধু টিভিতেই দেখেছে, সামনাসামনি দেখেনি। তারা দেখতে ছুটে এসেছে।

আমার ভালো লাগছে সবই। ক্লান্তি এখনও আসেনি। ভালো লাগছে এই কারণে যে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। লোকের প্রত্যাশা, তাদের স্বতস্ফূর্ততা যতটা দেখছি, আমার মনে হয়েছে তারা আমাকে মন থেকেই মেনে নিয়েছে। তবে ভোটের হিসাব-নিকাশ আলাদা। দেখা যাক কী হয়...।

মানুষের ভালোবাসার কথা আপনি জানতেন বলছেন। গত কয়েক দিনে নড়াইলের পথে-প্রান্তরে আপনাকে ঘিরে লোকের আবেগের যে বাঁধভাঙা স্রোত দেখা গেল, তাতে কি অবাক হয়েছেন?

মাশরাফি: ভীষণরকম অবাক হয়েছি। এত বেশি ভালোবাসে লোকে, ধারণা ছিল না। হ্যাঁ, নড়াইল তো আমার এলাকা, লোকের আবেগের কথা জানতাম। কিন্তু এই পরিমাণ ভালোবাসে, এতটা জানতাম না। রান্নাবাড়া বাদ দিয়ে, খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে মহিলারা রাস্তার ধারে বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কোনো পথ দিয়ে ৭টায় গিয়েছি, লোকে ৪টা থেকে বসে আছে। কত বৃদ্ধ লোক, দাঁত নেই একটিও, থুত্থুরে বৃদ্ধা… পথে দাঁড়িয়ে আছেন এক ঝলক দেখার জন্য। এসব তো অকল্পনীয় ছিল।

কেন এই ভালোবাসা, সেটি অনুভব করতে পেরেছেন? নিজের কাছে জানতে চেয়েছেন?

মাশরাফি: জানি না, অনেক কিছুই ব্যখ্যা করা কঠিন। অনেক সময়ই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণ খুঁজতে যাওয়া উচিত নয়। সেদিন বড়দিয়া ঘাটে একজন মুরুব্বি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেলেন, “বাবা, আমি শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, ৩০ তারিখ পর্যন্ত যেন বাঁচিয়ে রাখে। তারপর আল্লাহ নিয়ে যাক। জীবনের শেষ ভোট তোমাকে দিয়ে মরতে চাই।”

এই মানুষটির কাছে কি আমি কারণ জানতে চাইব? কোনো কারণ হয়তো আছে, কিংবা নেই। তিনি তার মতো করেই ভালোবেসেছেন।

এরকম আবেগ-ভালোবাসার আরও অনেক ঘটনা দেখেছি। কয়টার কারণ খুঁজব? সবারই হয়তো নিজের গল্প আছে, কারণ আছে। আমি শুধু তাদের ভালোবাসাটাই দেখেছি।

আমি সবসময়ই বর্তমানে থাকতে চাই। খেলার সময় খেলা, অন্য কাজের সময় অন্য কিছু। এখন এই কদিন ভোটের মাঠে ঘুরলাম। কেবলই মনে হচ্ছে, এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারলে জীবন স্বার্থক।

 

ক্রিকেটের মাঠ কঠিন না ভোটের মাঠ?

মাশরাফি: এখন পর্যন্ত ক্রিকেটের মাঠই কঠিন। ক্রিকেটের অনেক কঠিন সব অধ্যায় পেরিয়ে এসেছি। ভোটের মাঠের সত্যিকার বাস্তবতা হয়তো নির্বাচনের দিন বুঝব। সবাই অবশ্য বলে এটাই কঠিন বেশি। কিন্তু আমি তো এখনও সেই কঠিনের মুখোমুখি হইনি।

তবে, এটা ঠিক, ৫ দিনে ২০টি ইউনিয়নে লোকজনের কাছে যাওয়া, এটা ভীষণ কঠিন ছিল। অনেক সময় এক মাসেও এটা সম্ভব হতো না। আমি মোটামুটি ২০টি ইউনিয়নেই পা রাখার চেষ্টা করেছি। আরও কয়েক জায়গায় ইচ্ছা ছিল, সম্ভব হয়নি সময়ের কারণে। তবে এই মুহূর্তে আমি ঠিক আছি, কোনো সমস্যা হয়নি।

একটু অন্যভাবে বললে, খেলে মন জয় করা সহজ, নাকি ভোটের মাঠে আশ্বাস দিয়ে?

মাশরাফি: মন জয় করার কথা বললে, যদি আমি জিততে পারি নির্বাচনে, যদি আমার দল সরকার গঠন করে এবং আমি যে মানসিকতা নিয়ে এসেছি, সেই মানসিকতা যদি ধরে রাখতে পারি, তাহলে এর চেয়ে বড় কিছু আর হয় না। ক্রিকেটের তুলনাই হয় না এখানে, কোনো ভাবেই না। জীবনের তুলনায় ক্রিকেট কিছুই না।

নির্বাচনী সভায় আপনি সরাসরি কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। শুরু থেকেই বলছেন, প্রতিপক্ষ যেন আঘাত না পায়। এসব কি চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন, নাকি সহজাত?

মাশরাফি: আগেই বলেছি, আমি যতটা পারি, নির্বাচনী বিধি নিষেধ মেনে চলব। আমি মনে করি, এটাই আমার প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল। আমিও সেটা চেষ্টা করছি। প্রতিশ্রুতি দিইনি।

আর আঘাত না করা হয়ত খেলোয়াড়ী জীবন থেকেই এসেছে। প্রতিপক্ষকে সম্মান করা। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবা মানে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বোকামি। প্রতিপক্ষকে ঘৃণা করলে, তুমি পৃথিবীয় খারাপ মানুষ। স্পোর্টসম্যান হিসেবে খেলার স্পিরিটই আমি সবসময় মনে রাখি। আমি নিজের ভেতরের চিন্তার কথাই বলেছি। এখানে বানানো বা মেকি কিছু নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই যেন নিয়ম!

মাশরাফি: অনেকের থাকতে পারেন এমন। অনেকে থাকেন যার যার ব্যক্তিগত হিসাব নিয়ে। হ্যাঁ, দলের কোনো নির্দেশনা থাকলে সেটি থাকতে পারে। তবে সবকিছু তো নিজস্বতা দিয়েই করতে হয়!

দলের কথা বলছিলেন। দলের আদর্শ ও নিজের আদর্শ মুখোমুখি হলে সংঘাত এড়াবেন কীভাবে?

মাশরাফি: সেটা সময়ের হাতেই তোলা থাক; সত্যি বলতে, এতটা গভীরভাবে রাজনীতি এখনও শুরুই করিনি। ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিত আসতে পারে, নাও পারে। তবে আপনি কোন লেভেল পর্যন্ত যাবেন, সেটা তো সেই লেভেলে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝা যাবে না। আমি এখনও যে লেভেলে আছি, স্বচ্ছতা বজায় রেখেই কাজ করার চেষ্টা করব।

আদর্শ তো আসলে কিছু কথা বা দর্শন। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে দিন শেষে নিজের মত করে মানুষের উপকার করতে পারলেই হল। এমনিতে আইনসভার সদস্যদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় লোকে তাকিয়ে থাকে কাজের দিকে। আমি কাজ করতে চাই লোকের জন্য।

রাজনীতিবিদ মাশরাফির মূল মন্ত্র কি হবে?

মাশরাফি: আমি সৎভাবে রাজনীতি করতে চাই।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটা কতটা সম্ভব?

মাশরাফি: নিজেরটুকু তো সম্ভব। নিজে সৎ থাকলেই হল। ধরুন, সরকারি বরাদ্দ যা থাকে জনগণের জন্য, জনগণ যেন পুরোটা পায়। আমি বলছি না অন্যরা কেউ সেটা করে না। তবে আমি নিজের মত করেই করতে চাই। জনগণের হক যা থাকবে, তা যেন তারা ঠিকঠাক পায়।

বলা উচিত হবে কিনা জানি না, তবু বলছি, নিজেকে অসৎ পথ থেকে দূরে রাখার স্বার্থে… মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর আমার সমস্ত সম্পত্তি, টাকা-পয়সার হিসাবের কাগজপত্র আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা রেখে এসেছি। উনাকে বলে এসেছি, যদি নির্বাচিত হই, তাহলে এই হিসাবের সঙ্গে পাঁচ বছর পরে আমার সম্পদের হিসাব মিলিয়ে নেবেন, অবৈধ কিছু থাকতে পারে কিনা।

এটা কোনো বড়াই করা নয়, স্রেফ নিজেকে ধরে রাখতেই। মনে যদি কখনও অসৎ ভাবনা আসেও, আমি জানব যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার হিসাব আছে, অন্যায় পথে পা বাড়ানো যাবে না। আমি সৎ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। লোকে অনেক কিছু বলবে। রাজনীতি করলে হয়ত সুনাম-দুর্নাম দুটোই হবে। তবে আমি নিজের কাছে মাথা উঁচু করে থাকতে চাই। আয়নায় নিজেকে দেখার সাহস নিয়ে বাঁচতে চাই। আমি এভাবেই তৈরি হয়েছি। এভাবেই থাকতে চাই।

এভাবে তৈরি হলেন কেমন করে?

মাশরাফি: খুব সাধারণভাবে, প্র্যাকটিস। পারিবারিক প্র্যাকটিস। অনেকেই আমাদের পরিবার সম্পর্কে জানেন না। কিন্তু আমি এসব জেনে, এই আবহেই বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছি এভাবে। মূল্যবোধের চর্চা আমাদের পরিবারে বরাবরই দেখেছি।

প্রতিহিংসা শিখিনি। আমার সঙ্গে যে কখনও অন্যায় হয়নি, তা নয়। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে আমি জবাব দিয়েছি বা প্রতিশোধ নিয়েছি। আজ আমি বলছি যে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যেন আঘাত না পায়। অনেকে এটা নিয়েও গালমন্দ করে, লোক দেখানো মনে করে। কিন্তু আমি নিজের কাছে পরিষ্কার, এভাবেই বাঁচতে চাই।     

নির্বাচনী প্রচারের বড় একটি সময় ব্যয় করেছেন প্রত্যন্ত এলাকায়, এর কারণ কী?

মাশরাফি: কারণ, শহরে সবাই আমাকে দেখেছে। আমিও সব দেখেছি। এখানকার সব মাঠে আমি দাপিয়ে বেড়িয়েছি। এখানকার আলো-হাওয়ার স্বাদ পেয়েছি। এখনও যারা আমাকে দেখেনি, তাদের কাছে আগে গিয়েছি।

নির্বাচন করতে গেলে, সম্ভব সব অঞ্চলেই যাওয়া উচিত। তবে সবসময় তো পারা যায় না। এতে যদি অনেকে মন খারাপ করে থাকেন, তাহলে আমাদের কাজ কঠিন হবে। ৫ দিনে যত জায়গায় যাওয়া যায়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যেখানে যেতে পারিনি, ক্ষমা চেয়েছি, বাস্তবতা বুঝিয়েছে। তারপরও কেউ যদি তাদের এলাকায় না যাওয়ার জন্য মাইন্ড করেন আমার ওপর, তাহলে সেটা আমার প্রতি অবিচার হবে।

রাজনীতি করবেন, কবে থেকে ঠিক করলেন?

মাশরাফি: গভীরভাবে বললে, মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে। রাজনীতির কথা আগে ততটা ভাবিনি। তবে ছোটবেলা থেকে সবসময়ই চেয়েছি, মানুষের জন্য কিছু করার। রাজনীতি হয়ত সেই ইচ্ছেরই প্রতিফলন।

আওয়ামী রাজনীতিতে কেন, সেই ব্যখ্যা আপনি আগে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে আপনার যা পারিবারিক প্রেক্ষাপট, রাজনীতি করলে আওয়ামী লীগেই করার কথা, এটা কি বলা যায়?

মাশরাফি: চারপাশ দেখলে তেমনটিই বলতে হবে। আমার বাবা, তার চেয়ে বড় আওয়ামীমনা লোক আমি দেখি না। ছোট চাচা যুবলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, মেজো চাচাও আওয়ামীমনা।

আমার স্ত্রীর পরিবার যদি দেখেন, ওর দাদা মুক্তিযুদ্ধের কমাণ্ডার, বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার দাদাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি ইতিহাসে জড়িয়ে আছেন আমার দাদার বাবাও। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল আমাদের এলাকায়। নানা বাধায় আসতে পারেননি। আমার দাদার বাবা তখন মাইজপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। তিনি সেই অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তুলারামপুরে। সেখানে তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর হাতে নৌকা তুলে দেন।

গত কদিনে আপনার অনেকগুলো পথসভা হল এমন মাঠে, যেখানে আপনি ক্রিকেট খেলে বেড়ে উঠেছেন। নস্টালজিক হননি?

মাশরাফি: অতীত ভাবার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। অল্প সময় থেকেছি, অনেক লোকের ভিড়। তবে মনে তো পড়েছেই। সব মাঠেই খেলেছি। এই যে আজকেই (বৃহস্পতিবার) একটি মাঠে পথসভা করলাম, এখানে কত খেলেছি! এমনকি মাস দুয়েক আগেও ট্রলারে করে বউ-বাচ্চাসহ ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম, বটতলায় বসে সময় কাটালাম। আজ সেখানে গেলাম ভিন্ন রূপে। সবই বলে দেয়, জীবন কতটা নাটকীয়।

নির্বাচনী প্রচারের অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হল। অনেককেই দেখা গেছে, আপনাকে ধরে কাঁদতে, আপনাকে ছুঁয়ে হাসতে। আপনার নিজের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কিছু অভিজ্ঞতা কি ভাগাভাগি করা যায়?

মাশরাফি: অভিজ্ঞতা কতই তো হল। সব বলা উচিতও না। এক বৃদ্ধের কথা তো আগে বললাম। আরেকটি ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। সেখানে আমি ছিলাম না। কয়েকজন গিয়েছিল একটি বাড়িতে আমার জন্য ভোট চাইতে। ওরা উন্নয়নের কথা-টথা বলে চলে আসছিল। এক বৃদ্ধা পেছন থেকে ডেকে বললেন, “এই দাঁড়া, মাশরাফির জন্য ভোট চাস? দোয়া চাস? ওর জন্য কেন চাইতে এসেছিস! শোন, আমার ক্যান্সার, কতদিন বাঁচব জানি না। আমার কিছু লাগবে না। ওকে ভোট দিয়েই মরব।”

আপনিই বলুন, এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন মানুষের কী আছে! ৫০০ উইকেট নিয়ে কি একজন মৃত্যুপথযাত্রীর এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়া যাবে?

ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত একটি ছেলে, কেমো নিতে হয়। তার বিছানা থেকে ওঠা নিষেধ, তবু নির্বাচনের প্রচারে ছুটে আসে। আমার ঢাকার বাসায় মাঝে মধ্যে কাজ করেন একজন কলের মিস্ত্রি, মোনেম। আমি নড়াইলে আসার আগে থেকেই ছবিতে দেখি সে চলে এসেছে, মিছিলে প্রতিদিন সবার আগে। কোথায় থাকবে, কী খাবে, ঠিক নেই… চলে এসেছে।

আরও অসংখ্য আছে। এসব কি শুধুই ক্রিকেটের জন্য? এক হাজারটা উইকেট নিলেও তাদের কী? আমার কেবলই মনে হয়, মানুষের জন্য কিছু করে মরে গেলেও শান্তির। আমি সেই শান্তির পরশে থাকতে চাই।

মনে সংশয় নিশ্চয়ই ছিল- সিদ্ধান্ত ঠিক হলে কি ভুল?

মাশরাফি: সত্যি বলতে, প্রথম দিকে ভেবেছি। কারণ একটা জগত থেকে হুট করে আরেকটি জগতে এসেছি। অনেক ভাবনাই এসেছে। পরে মনে হয়েছে, ৫০০টা লোকের গালি না হয় খেলাম, পাঁচটা লোকের উপকার তো করতে পারব! এটাই শান্তি।

বাস্তবতার মুখোমুখি কজন হতে পারে? আমি তো দুনিয়ার সবচেয়ে কমফোর্ট জোনে ছিলাম। ক্রিকেট খেলি, লোকে প্রবল ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসা আমার সমাজ, আমার দেশের কী কাজে লাগে? তাদের ভালেবাসাকে আমি অবমূল্যায়ন করছি না। কিন্তু সেটা ধরে বেঁচে থাকার মত স্বার্থপরও আমি নই।

ওই ভালোবাসা সে জগতে পেয়েছি, সেখানে আমি নিজের সর্বোচ্চটা উজার করে দিয়েছি। সামনেও যে কদিন খেলব, সবটা দিয়ে খেলব। কিন্তু আমার কাছে সত্যিকারের মানসিক তৃপ্তি হবে লোকের জন্য কিছু করতে পারলে।

কমফোর্ট জোন থেকে কজন বের হতে চায়? আমি আমার জন্মস্থান, নিজ শহরের জন্য বের হয়েছি। দেখা যাক সামনে কতটি এগোতে পারি।

মাঠে নামার পর নিজের কাছে স্পষ্ট হতে পেরেছেন?

মাশরাফি: মাঠে নামার পর, অসহায় মানুষদের কাছে যখন যাচ্ছি, তাদের আকুতি দেখছি, লোকের আবেগের জোয়ার দেখছি, তখন কে কী গালি দিল, কে পেছন থেকে টানল, সব ভুলে গেছি। মাঠে নামার পর এই পাঁচদিনে সব সংশয় উড়ে গেছে।

যদি হেরে যান?

মাশরাফি: তাহলেও আক্ষেপ থাকবে না। হেরে গেলে বুঝব, নড়াইলে আমার গ্রহণযোগ্যতা ওই পর্যায়ে নেই। কিন্তু আমি নিজে অন্তত জানব, নড়াইলে কাজ করার জন্য আমি চেষ্টা করেছি। আর যদি জিতি, তাহলে বুঝব যে লোকের আস্থা আছে।

জিততে না পারলে রাজনীতির ভবিষ্যত কী হবে?

মাশরাফি: এর উত্তর সময়ের হাতে। আমি সবসময়ই বর্তমানে থাকতে চাই। এই ক্ষেত্রে ভবিষ্যত চিন্তা করা বোকামি।

মানুষের তো প্রত্যাশার শেষ নেই আপনার কাছে। রাস্তা, ব্রিজ, হাসপাতাল, স্কুল- অনেক প্রত্যশার কথা এসেছে প্রতিটি জনসভায়। নির্বাচিত হলে এই আকাশচুম্বি প্রত্যাশা মেটাতে পারবেন? ভয় লাগছে না?

মাশরাফি: আপনারাও দেখেছেন, নড়াইল কতটা অবহেলিত। রাস্তাঘাটের অবস্থা কতটা জঘন্য। গ্রামে একজন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে আনতে আনতেই জীবন শেষ, এত খারাপ রাস্তা। আরও কত সমস্যা এই অঞ্চলে। নির্বাচিত হলে এবং আমার দল সরকার গঠন করলে অবশ্যই এসব আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি উনি পাশে থাকবেন। আর প্রত্যাশার কথা বললেন, সেটাই তো হবে আমার কাজ।

কিন্তু অনেকে তো মনে করছে, মাশরাফি এসে ম্যাজিকের মতো সব বদলে দেবেন।

মাশরাফি: সেটা যে সম্ভব না, লোকেও সেটা জানে। সবকিছুর জন্য সময় লাগে। তবে আমি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করব, এই কথা দিতে পারি। সততার কথা তো আগেই বললাম। এটাই তো চ্যালেঞ্জ। জানি কতটা কঠিন। তবু নিলাম, দেখা যাক।

প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বলেছেন ‘হীরার টুকরা’। যেভাবে আপনাকে নানা সময়ে উনি তুলে ধরেছেন, তাতে তো পাশে থাকার ভরসা পাওয়ার কথা।

মাশরাফি: সেটাই বিশ্বাস করি। উনার স্নেহ আমি বরাবরই পেয়েছি। এবার যেমন, নির্বাচনী প্রচার শুরুর সময় আমার খেলা চলছে, উনি বলেছেন, “তুমি খেলায় মন দাও, আর কিছু ভাবতে হবে না।”

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের শেষ ম্যাচ শেষ হওয়ার পরপরই ফোন করেছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, আমার পায়ে ইনজুরি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তোমার এলাকায় যাওয়ার দরকার নেই। আগে পায়ের চিকিৎসা করাও। প্রচার দল দেখবে।”

সিরিজ শেষে ভিডিও কনফারেন্সের জন্য গণভবনে গেলাম। ইনজুরির কারণে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম। প্রধানমন্ত্রী খেয়াল করেছেন। সেদিন ভিডিও কনফারেন্স হয়নি। পরে নতুন তারিখে ভিডিও কনফারেন্সের জন্য গেলাম সুধা সদনে। দোতলায় উঠতে হবে। দেখি সিঁড়ির নিচে একটা চেয়ার রাখা, আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দোতলায় তোলা হবে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী আগের দিন বলে রেখেছেন, “মাশরাফির পায়ে ব্যথা, সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলে বাড়বে।”

আমি হেঁটেই উঠেছি। কিন্তু দেখুন, নির্বাচনসহ এতসব ব্যস্ততার মাঝেও তিনি এইটুকু মনে রেখেছেন! উনার ভরসাতেই আমি স্বপ্ন দেখার সাহস করেছি। এমনকি উনার আশপাশের মানুষেরাও দারুণভাবে সহায়তা করছেন আমাকে।

গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে যে টেনশন থাকে তার সঙ্গে নির্বাচনের আগের টেনশনের তুলনা করতে বললে?

মাশরাফি: তুলনাই হয় না। এখন আমি একদম রিল্যাক্সড আছি। কোনো টেনশন নেই। আমি নিজের কমফোর্ট জোন ভেঙে এখানে এসেছি। এখন নড়াইলবাসীর দেখানোর পালা। আমার হারানোর কিছু নেই। যদি হেরে যাই, ভবিষ্যতে অন্তত কেউ আঙুল তুলতে পারবে না যে আমি নড়াইলের জন্য কিছু করতে চাইনি। জিতে গেলে কিছু করার চ্যালেঞ্জ নিতে আমি প্রস্তুত।

খেলায় যখন মাঠে নামি, বাংলাদেশের হয়ে নামি। অনেক টেনশন থাকে। এখানে আপাতত স্রেফ ‘মাশরাফি’ আছে। বাংলাদেশ আর মাশরাফি তো এক নয়। এখন নড়াইলের মানুষ কি করবে, সেটা তাদেরই সিদ্ধান্ত।

যারা গালি দিচ্ছে, হয়তো অন্য দল করে। হয়তো গভীরভাবে ভাবে না। আমি তাদেরকে অসম্মান করতে চাই না। আমিও যদি পাল্টা গালি দিই বা অসম্মান করি, তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য কি থাকল?

বসে বসে অনেক কথা বলা যায়। আমি এসেছি মানুষের জন্য কাজ করতে। তিন লাখের বেশি ভোটারসহ এলাকার ৬-৭ লাখ লোকের দায়িত্ব নিতে চাই। সহজ কাজ নয়। অনেক মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা, অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।

লোকে যারা রাজনীতিবিদদের গালি দেয়, তারা আবার তাদেরটাই ভোগ করে। বাংলাদেশে মতাদর্শ এখন কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে চলে গেছে। এটা হয়ত আমি বদলাতে পারব না। আমি আমার এলাকায় মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করতে চাই। দেশের স্বার্থে, নড়াইলের স্বার্থে যেন মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেই মানসিকতা দেখতে চাই।