মাশরাফির নির্বাচনে সুমির চমক

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজাকে ঘিরে উন্মাদনা অনুমিতই ছিল; তবে নড়াইলের ভোটের মাঠে এবার বড় চমক হয়ে এসেছেন তার স্ত্রী সুমনা হক সুমি।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2018, 06:41 AM
Updated : 28 Dec 2018, 06:53 AM

মাশরাফির মতই নড়াইল-২ আসনে চষে বেড়িয়েছেন ত্রিশোর্ধ এই তরুণী। নড়াইল সদর ও লোহাগড়ার নানা প্রান্তে পথসভা করেছেন, তবে বেশি জোর দিয়েছেন উঠোন বৈঠকে। এলাকার নারীদের কাছে গিয়ে শুনছেন তাদের ভাবনা। স্বামীর জন্য ভোট চেয়ে আশ্বাস দিয়েছেন পাশে থাকার।

বারবার চোটের পরও ক্রিকেট ক্যারিয়ারে টিকে যাওয়ার পেছনে সবসময়ই নিজের স্ত্রীকে আড়ালের নায়িকা বলে আসছেন মাশরাফি। সংসারের সবকিছু সুমি নিপুণ দক্ষতায় সামলেছেন বলেই সব ভুলে শুধু খেলায় মন দিতে পেরেছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অধিনায়ক।

রাজনীতির ক্যারিয়ারের শুরুতেও স্ত্রীর ভরসা আর নির্ভরতার ছায়া পাচ্ছেন মাশরাফি। আর স্বামীর পক্ষে প্রচারে নেমে নিজের ব্যক্তিত্ব, বক্তৃতা ও আন্তরিকতা দিয়ে সুমিও ভোটারদের নজর কেড়েছেন।

নতুন পরিচিতি

এমনিতে ক্রিকেট আঙিনায় মাশরাফির স্ত্রী ‘একটু অন্তর্মুখী মেয়ে’ হিসেবেই পরিচিত।ক্রিকেটের নানা আনুষ্ঠানিকতা বা আয়োজনে মাশরাফির সঙ্গে তার উপস্থিতি খুব কমই দেখা গেছে।

তবে একাদশ সংসদ নির্বাচন সুমির ব্যক্তিত্বের আরেকটি দিক সামনে নিয়ে এসেছে। নড়াইল শহর থেকে গ্রামে গ্রামে শোনা যাচ্ছে মাশরাফির স্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারের গল্প।

কদিন আগে এক জনসভায় সুমি বলছিলেন, “৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আপনারা মাশরাফিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। নড়াইলে নতুন বছরের সূর্য হবে উন্নয়নের সূর্য।”

সুমির বলা সেই ‘উন্নয়নের সূর্য’ এখন ফিরছে লোকের মুখে মুখে।

সদর উপজেলায় একটি উঠোন বৈঠকে সুমির প্রচার দেখে মুগ্ধ একটি বেসরকারি সংস্থার চাকুরে আসমাউল হুসনা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টিভিতে দেখে আর অনেক লেখায় পড়ে মাশরাফি ভাইকে নিয়ে তো একটা ধারণা হয়েছেই। কিন্তু ভাবি যে এত আন্তরিক, এত চমৎকার কথা বলেন, এটা ভাবতে পারিনি। খুব সহজেই মিশেছেন আমাদের সঙ্গে। একদম আপন করে নিয়েছেন খুব দ্রুত। আমার মনে হয়েছে, উনাদের ওপর ভরসা করা যায়।”

সুমির নিজের উপেজলা লোহাগড়ার কলাগাছি এলাকায় একটি চায়ের দোকানে কথা হলো ব্যাংকের চাকুরে জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে।

তিনি বললেন, “মাশরাফির স্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কথাবার্তায় খুবই আন্তরিক মনে হয়েছে, ব্যক্তিত্বও ফুটে উঠেছে। মাশরাফির তো নড়াইলে নতুন করে পরিচয়ের কিছু নেই। আমার মনে হয়েছে, আমাদের মেয়েও ভোটের মাঠে মাশরাফির বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।”

ভোটের যাবতীয় আলোচনা, পাড়া-মহল্লার আড্ডা, আর চায়ের কাপের ঝড়ে মাশরাফির পাশাপাশি সুমির প্রসঙ্গও ঘুরে ফিরে আসছেন। তরুণ-যুবাদের অনেকেই মজা করে বলছেন, ‘ভাইয়ের জনপ্রিয়তার দুর্গে ভাবি হানা দিয়েছেন’।

‘ভাইয়ের চেয়েও ভালো বোলিং’

বৃহস্পতিবার মাশরাফির একটি পথসভা ছিল লোহাগড়া উপজেলার দেবী গ্রামে, যেখানে সুমির জন্ম ও পড়াশোনার শুরু। সময়ের পরিক্রমায় গ্রাম ছেড়ে থিতু হয়েছেন শহরে, নানা বাস্তবতায় এখন সেখানে যাওয়া হয় কদাচিৎ।

এবার স্বামীর ভোটের প্রয়োজনে দেবী গ্রামে যাওয়া হলেও সুমির ভেতরে ছিল শেকড়ে ফেরার উচ্ছ্বাস। তেমনি গ্রামবাসীর মধ্যেও ছিল সুমিকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ।

দেবী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পথসভায় সুমি নিজ গ্রামের অধিকার নিয়েই ভোট চাইলেন এলাকার জামাইয়ের জন্য।

“আমি আপনাদেরই মেয়ে। এই গ্রামেরই মেয়ে। আমার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি এই গ্রামেই। দাদা মুক্তিযুদ্ধের কমাণ্ডার ছিলেন, বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আজকে এসেছি আপনাদের জামাইয়ের জন্য ভোট চাইতে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, আমার ভোট চাওয়া লাগবে না। আপনারাই ওকে জয়ী করার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন। এজন্য আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”

স্ত্রীর কয়েক মিনিটের বক্তৃতার পর কথা বলতে শুরু করেন মাশরাফি। তার ভাষণপর্ব শেষে করতালির মাঝেই জমায়েত থেকে ভেসে আসে একটি কণ্ঠ- “ভাইয়ের চেয়ে ভাবি ভালো বোলিং করিছে। দারুণ বলিছে, দারুণ...।”

মানুষের ভালোবাসা

পারিবারিক সূত্রে রাজনীতর সঙ্গে খানিকটা পরিচয় ছিল সুমির। তবে এভাবে পথে-প্রান্তরে ঘুরে, উঠোনে, বাড়িতে গিয়ে গণসংযোগের অভিজ্ঞতা এই প্রথম।

ক্রিকেট তারকা মাশরাফির জনপ্রিয়তা সুমির কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভোটের মাঠে স্বামীর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ তাকে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। সেই বিস্ময়ের কথা তিনি শোনালেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

“মাশরাফি যে অসম্ভব জনপ্রিয়, এটা তো জানতামই। তবে আমি ভেবেছিলাম, এই জনপ্রিয়তা বুঝি মানুষের সহজাত প্রবণতা থেকেই। আমরাও তো অনেক নায়ক-নায়িকার ফ্যান, কবি-সাহিত্যিকদের ভক্ত। কিন্তু নড়াইলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাশরাফির যে আবেদন দেখছি, এটা আসলে প্রথাগত জনপ্রিয়তা নয়। এর নাম ভালোবাসা, নিখাদ ভালোবাসা।”

সুমি বলেন, “আমিও কল্পনা করতে পারিনি, লোকে ওকে কি পরিমাণ ভালোবাসে। আমি ওর স্ত্রী, আমাকে দেখেই, আমাকে একটু ছুঁয়ে কত কত মহিলা কেঁদে ফেলছেন! আমাকে দেখার জন্যই অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছেন, পথসভায় অপেক্ষা করছেন। মেয়েদের অনেকে এমন ভাবে আমাকে দেখছেন বা জড়িয়ে ধরছেন, যেন আমি খুব আপন কেউ। সবই তো মাশরাফিকে ভালোবাসে বলেই।”

এই তীব্র ভালোবাসার কিছু কারণ সুমি খুঁজে পান, কিছু আবার মেলাতে পারেন না কিছুতেই।

“আমি মূলত নারীদের কাছেই যাচ্ছি। তাদের অনেকে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কিছু জানে না। ক্রিকেটার মাশরাফি গুরুত্বপূর্ণ কি না- সেটা বোঝারও কারণ নেই। তারা শুধু জানে মাশরাফি তাদের সন্তান। সবার এক কথা, ‘এত ভালো মানুষকে ভোট না দেওয়ার কারণ নেই।’ এই ভালো মানুষ কথাটিই সবার কাছে শুনছি।”

 

রাজনীতিতে আসার আগে মাশরাফি এলাকায় তরুণদের সংগঠিত করে যেসব স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করেছেন, সে কারণে নড়াইলের মানুষের মধ্যে তার অন্যরকম জনপ্রিয়তা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এসবের বাইরে মাশরাফিকে ঘিরে ভোটের প্রচারে যে উন্মাদনা দেখেছেন, তাকে ‘ব্যখ্যাতীত ভালোবাসা’ ছাড়া অন্য কোনো অভিধা দিতে পারছেন না সুমি।

“দাবি দাওয়া, চাওয়া-পাওয়ার কথা তো অনেকেই বলছেন। বিশেষ করে রাস্তাঘাট উন্নয়নের কথা। তবে বিশ্বাস করুন, বেশির ভাগ মানুষের চাওয়ার খুব বেশি নেই। আমি এমন গ্রামে গিয়েছি, অনেক বাড়িতেই টিভি নেই। অনেক মহিলা জীবনে ক্রিকেট দেখেনি। তাদের কথা, আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। একটা ভালো মানুষকে ভোট দেব, এটাই শান্তি।”

সাত বছরের মেয়ে আর চার বছরের ছেলেকে নিয়ে মাশরাফির সংসার স্ত্রী সুমিই আগলে রেখেছেন এতদিন। পরিবারের কর্তা রাজনীতিতে জড়ানো মানে এখন আরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে- সেটাও সুমি জানেন। বললেন, মনে দ্বিধা যেটুকু ছিল, গত কয়েক দিনে তা দূর হয়ে গেছে।

“আমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না। এত অসহায় মানুষ দেখেছি, যাদের চাওয়া, স্বপ্ন খুব বড় কিছু নয়। অনেকের চাওয়া নেই কিছুই। তাদের জন্যই কিছু করতে ইচ্ছে করে। সামান্য একটু নির্ভরতার ছায়া পেলেই তারা অনেক খুশি।”

আর মানুষের জন্য কিছু করার আকুতিটা নির্বাচানের ফলাফলে আটকে থাকবে না- এমন প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছেন নৌকার প্রার্থী মাশরাফির স্ত্রী।

“অবশ্যই আমরা নির্বাচনে জিততে চাই। তবে এই কদিনে প্রান্তিক লোকজনকে কাছ থেকে দেখে মনস্থির করে ফেলেছি, জয় হোক বা না হোক, এই অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতেই হবে। মাশরাফি তো বরাবরই লোকের জন্য অনেক কিছু করে আসছে। এবার নির্বাচনের প্রচারে নেমে আমার যে অভিজ্ঞতা হল, মনে হচ্ছে, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মতো তৃপ্তি আর কিছুতে আসবে না।”