ভোটের মাঠে মাশরাফির সঙ্গে এক দিন

এ এক নতুন মাঠ, নতুন চ্যালেঞ্জ! বাইশ গজের নিয়মগুলো এখানে খাটে না। দর্শকদের প্রত্যাশা কেবল জয় পরাজয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। 

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2018, 06:36 AM
Updated : 26 Dec 2018, 07:23 AM

রাজনীতির এই ময়দানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার অভিষেক ঘটছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

এই ম্যাচ জিততে পারলে ক্রিকেট মাঠের নেতা মাশরাফি নড়াইল-২ আসনের ভোটারদের নেতা হয়ে বসবেন আইনসভায়। ৩০ ডিসেম্বর সেই পরীক্ষায় পাস করতে চলছে দিনরাত প্রস্তুতি।  

খেলার মাঠের নৈপুণ্যে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে বহুবার আনন্দে ভাসানো, রোমাঞ্চে জাগানো মাশরাফির লক্ষ্য আপাতত নড়াইল সদরের একাংশ এবং লোহাগড়া উপজেলার ৩ লাখ ১৭ হাজার ভোটারকে তুষ্ট করা।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পরও মাশরাফি ব্যস্ত ছিলেন ক্রিকেট নিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শেষ হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। সেই সিরিজে পাওয়া হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট তার ভোটের মাঠে নামা বিলম্বিত করেছে আরও কয়েক দিন।

শেষ পর্যন্ত তিনি নড়াইলে এসেছেন ২২ ডিসেম্বর, নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে। তাতে প্রচারের সময় কমে গেলেও একটি জায়গায় মাশরাফি বাকি সাত প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। ভোটারদের কাছে নিজেকে চেনাতে হচ্ছে না তাকে।

নিজের এলাকায় রাজনীতির অচেনা আঙিনায় কেমন খেলছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ মাশরাফি?

‘ওয়ান ডে’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়কের সঙ্গে তার ভোটের প্রচারে পুরো এক দিন কাটিয়ে খেলার মাঠের সেই উদ্দীপ্ত, প্রাণবন্ত তরুণকেই পাওয়া গেল।

দুই মন্ত্রে দিনের শুরু

সব কাজ শেষ করে সোমবার রাতে বিছানায় যেতে যেতে প্রায় ভোর। মঙ্গলবার তাই মাশরাফির প্রচার শুরু হল একটু দেরিতে। বাসা থেকে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে ১০টা। বাসার উল্টো দিকে নির্বাচনী অফিস, সেখানে খানিকক্ষণ বসে ঝালিয়ে নিলেন দিনের পরিকল্পনা। সব কর্মীকে মনে করিয়ে দিলেন তার প্রচারের দুই মন্ত্র- ‘ছোটো বহর’ আর ‘প্রতিপক্ষের নিরাপত্তা’।

আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী মাশরাফি প্রচারের শুরুতে প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে। দ্রুত পথ চলতে তাই ভরসা মোটর সাইকেল। তবে তা যেন কোনোভাবেই ‘শো ডাউন’ জাতীয় চেহারা না পায়, মানুষের মনে যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, সেজন্য শুরুর দিন থেকেই সতর্ক মাশরাফি। প্রচারের বহর যেন ছোটো হয়, কর্মীদের তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বারবার।

শুরুর দিন থেকে আরেকটি কথা আপ্তবাক্যের মতো উচ্চারণ করে যাচ্ছেন মাশরাফি- নির্বাচনী প্রতিপক্ষের কেউ যেন কোনোভাবে আঘাত না পায়, অপদস্থ যেন না হয়, কোথাও যেন বাধার মুখে না পড়ে।

শুধু নিজের কর্মীদের নয়, স্থানীয় প্রশাসনকেও মাশরাফি অনুরোধ করেছেন প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে দুদিন আগে টেলিফোনে আশ্বস্ত করেছেন, তার প্রচার নির্বিঘ্ন করতে সম্ভব সবরকম সহায়তা করবেন।

মঙ্গলবার দিনের প্রচার শুরু করার আগে এ দুই বার্তা নিজের কর্মীদের আবারও মনে করিয়ে দিলেন মাশরাফি।

পথসভা যেন প্রাণের সভা

মাশরাফি তার প্রচার কৌশল সাজিয়েছেন মূলত পথসভাকে কেন্দ্র করে। গত রোববার থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পথসভা করছেন তিনি।

মঙ্গলবার দিনের প্রথম পথসভা ছিল ঝিকিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সারা দিনে নড়াইল ও লোহাগড়া মিলিয়ে ১৫টি পয়েন্টে পথসভা করার পরিকল্পনা থাকলেও পথ চলতে চলতে যোগ হয় আরও দুটি। সকাল থেকে শুরু করে একের পর এক পথসভায় পেরিয়ে যায় সন্ধ্যা।

প্রতিটি পথসভার চিত্র একইরকম। মাশরাফির আসার খবরে আগে থেকেই ভিড় করে থাকছে মানুষ। বাইক থেকে নেমে ভিড় ঠেলে মঞ্চ পর্যন্ত যাওয়াই মুশকিল। স্বস্তস্ফূর্ত জনসমাগমে, গলা ফাটানো স্লোগানে পথসভাগুলো রূপ নিচ্ছে প্রাণের মেলায়।

মাশরাফি নড়াইলেরই সন্তান, ডাক নাম কৌশিক। এলাকার অনেকে তাকে ডাক নামেই ডাকে। তারপরও ভোটের প্রচারের মধ্যে তাকে কাছ থেকে দেখে সহস্র জোড়া চোখে আনন্দময় বিস্ময়। কিশোর-তরুণ-যুবা সবাই যেন মোহাবিষ্ট।

ঝিকিরা মোড়ের পথসভায় যোগ দিতে আসা প্রবীণ আসলাম শেখের কথায় মাশরাফির জন্য ভালোবাসা বেশ স্পষ্ট। 

“শুধু টিভিতেই দেখেছি কৌশিককে, আজকে সামনাসামনি দেখে একটু চোখ জুড়াতে চাই। আমাদের নড়াইলের সম্পদ।”

পথসভাগুলোতে মাশরাফির বক্তৃতার মূল সুর মোটামুটি একইরকম। কোথাও খুব বেশি সময় নেননি, রাজনীতির খুব জটিল কথাও বলেননি। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখানো বা জাঁকালো প্রতিশ্রুতির পথেও তিনি হাটছেন না। তবে বারবারই কথা দিচ্ছেন জনগণের কাছে শিগগিরই ফিরে আসার।

“আজকে আমি খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছি। শুধু জানাতে এসেছি, আমার সাধ্যে যতটুকু থাকবে, এই নড়াইল-লোহাগড়ার মানুষের জন্য করব আমি। আমাকে যোগ্য মনে করলে নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। এরপর সময় নিয়ে আবার আপনাদের কাছে আসব আমি, আপনাদের নিয়েই চেষ্টা করব সমস্যা যত আছে, যতটা পারা যায় সমাধান করার। উন্নয়নের আলো এই নড়াইল-লোহগড়াকে আলোকিত করবেই।”

প্রতিটি পথসভায় নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। মাশরাফিও তাদের কথা উল্লেখ করেছেন আলাদা করে, জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা। শুনিয়েছেন তাদের দাবি মেটানোর আশ্বাস।

পথে পথে ভালোবাসার জোয়ার

মাশরাফির এক পথসভা থেকে আরেক পথসভায় ছোটার পথও সাজানো ছিল সভার আয়োজনে। রাস্তার দুই ধারে গাছের ছায়ার নিচে একটু পরপরই সার বেধে দাঁড়িয়ে ছিল মানুষ। বাড়ির সামনে, আঙিনার পাশে, ব্রিজ-কালভার্টের ওপরে তাদের অপেক্ষা- যদি এক ঝলক মাশরাফিকে দেখা যায়, যদি একটি বার ছোঁয়া যায়!

তাদের এইটুকু চাওয়া পূরণ করতে মাশরাফিও কার্পণ্য করছিলেন না, ধৈর্য্য হারাচ্ছিলেন না। পথে ছোটখাটো জমায়েত দেখলেই নেমে পড়ছিলেন মোটর সাইকেল থেকে। কারও সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলেন, কাউকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন, আবার বয়স্ক কারও আশীর্বাদে ধন্য হচ্ছিলেন নিজে। ছবির তোলার আব্দার মেটাতেও তার যেন ক্লান্তি নেই!

নির্বাচনের প্রার্থী মাশরাফির দেখা পেয়ে রাস্তার পাশের ভিড়ের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল হুল্লোড়। চলন্ত বাইক থেকে তার বাড়ানো হাতের স্পর্শ পেয়ে কেউ আবার ভেসে যাচ্ছিলেন উচ্ছ্বাসে।

পথের ধারে আর বাড়ির সামনে মা-খালা-বোনেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন এলাকার ছেলে কৌশিকের জন্য, তাদের কারও হাতে ছিল ফুলের মালা, কারও হাতে ফুলের পাপড়ি। সেই মালা মাশরাফির গলায় পরিয়ে দিয়ে, মাথার ওপর পাপড়ি ছিটিয়ে দিতে পেরেই যেন ভুবন জয়ের আনন্দ।

আনন্দের প্রকাশ দেখা গেল অশ্রুতেও। মধুমতির পাড়ে, বড়দিয়া ঘটে মাশরাফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে অশীতিপর এক বৃদ্ধার কান্না আর থামতে চাইছিল না।

মাশরাফির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছিলেন, “বাবা, আমার জীবনের শেষ ভোট তোমাকে দিয়ে শান্তিতে মরতে পারব।”

আবেগের এই তীব্রতা কখনও কখনও নাড়িয়ে দিয়েছে মাশরাফিকেও। অবিশ্রান্ত হাত নাড়া আর কুশল বিনিময়ের ফাঁকে চোখের কোণায় জমে ওঠা জল কি তিনি গায়ের কালো চাদরে মুছে ফেলছিলেন?

ভাসমান ‘লাঞ্চ’

ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে গ্রামে ছোটাছুটি। খাওয়ার সময় কোথায়!

দুপুর পেরিয়ে তখন বিকেল হব হব করছে, মধুমতির ওপারে পথসভা শেষ করে আবার ট্রলারে ফিরছিলেন মাশরাফি।

ট্রলারের ভিড়ে কেউ একজন তখন বাড়িয়ে দিলেন একটি সেদ্ধ ডিম, সঙ্গে এক টুকরো রুটি। খানিক পর আরেকজনের হাত থেকে এলো সিঙ্গারা। ব্যস, মধুমতি নদীতে হয়ে গেল মাশরাফির ভাসমান লাঞ্চ! ট্রলার থেকে নেমেই আবার ছুট নতুন গন্তব্যে।

‘জামাই আদর’

মাশরাফির স্ত্রী সুমনা হক সুমির জন্মস্থান লোহাগড়া। এ উপজেলার সব জায়গায় মাশরাফি পাচ্ছেন ‘জামাই আদর’। বক্তৃতায়, স্লোগানে স্থানীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে আমজনতা, সবার মুখে মুখে শুধু ‘জামাই’।

সারোল বউ বাজার মাঠের পথসভায় জামাইকে বরণ করে নেওয়া হলো বিশেষ আপ্যায়নে। মাইকে ঘোষণা করা হল, জামাইয়ের জন্য এলাকার শাশুড়িরা শীতের পিঠা বানিয়েছেন। সেই পিঠা-পুলি খেয়ে তবেই মঞ্চে উঠতে হবে জামাইকে। মাশরাফিও তৃপ্তি ভরে পিঠা খেয়ে হাসিমুখে পা রাখলেন মঞ্চে।

শেষ বিকেলে পথসভা ছিল ঘাঘা লঞ্চ ঘাটে। মধুমতির ভাঙন কবলিত ওই এলাকার মানুষের প্রত্যাশা অনেক মাশরাফির কাছে। এলাকার চেয়ারম্যান মাইকে ঘোষণা করলেন, “৩০ তারিখ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী করে আমরা মাশরাফিকে জামাই আদর করব। তারপর জামাই আমাদের খেয়াল রাখবেন।”

নড়াইল সদর ও লোহাগড়া, পাশাপাশি দুই উপজেলায় অনেক কিছু নিয়েই আছে রেষারেষি। তবে মাশরাফির স্পষ্ট ঘোষণা, “দুটোই আমার এলাকা, দুটিই নড়াইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নির্বাচিত হলে উন্নয়নের ঢেউ লাগবে সব জায়গায়।” 

‘দল যার যার মাশরাফি সবার’  

গত ২০ ডিসেম্বর লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মাশরাফির নির্বাচনী জনসভায় তিনি নিজেই উপস্থিত ছিলেন না। ঢাকার সুধা সদন থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি যোগ দেন সেই জনসভায়। 

এরপর এলাকায় ফিরে গত রোববার থেকে যে পথসভাগুলো মাশরাফি করছেন, তাতে জনসমাগম দেখেই স্থানীয়দের অনেকে অবাক। 

আমাদা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পথসভায় স্থানীয় বাসিন্দা আজহার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “নড়াইলে শেখ হাসিনা এসেছিলেন অনেক বছর আগে। তারপর আর কারও সভায় এত লোকের সমাগম দেখা যায়নি।”

নড়াইল-লোহাগড়ায় লোকের মুখে মুখে ফিরছে, কোনো প্রার্থীর পক্ষে এমন জনজোয়ার আগে নাকি কখনও দেখা যায়নি। দলীয় কর্মীদের কাছেই উল্টো মাশরাফির জন্য ভোট চাইছে এলাকার মানুষ। ভ্যান-ইজিবাইকের চালক ভোট চাইছে যাত্রীর কাছে। নিজেদের খরচে ব্যানার বানিয়ে, লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করছে স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন। সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হলেও নিজের কাজের ফাঁকে মাশরাফির ভোটের প্রচারে অংশ নিচ্ছেন অনেকে।

সেই জোয়ারের ঢেউ লেগেছে অন্য সব দলেও। বয়সা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একজন বললেন, “আমি বিএনপির পদধারী নেতা। কিন্তু আমার কাছে মাশরাফিই আগে। আমাদের অনেকের কাছেই দল যার যার, মাশরাফি সবার।”

শেষেও শেষ নয়

পথসভা শেষেই শেষ নয় প্রচারের কাজ। প্রতি রাতেই বিভিন্ন সংগঠন, গ্রুপের সঙ্গে মাশরাফির সভা, বৈঠক থাকছে।

মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভাসহ এরকম দুটি বৈঠক করে তারপর আবার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে মাশরাফি বসেন পরের দিনের পরিকল্পনা সাজাতে।

ক্রিকেট মাঠে মাশরাফি একজন সহজাত নেতা। নড়াইলের বহু মানুষের কাছে তার আবেদন যে ক্রিকেট ছাড়িয়ে জীবনের সীমানা ছুঁয়েছে, তার নমুনা দেখা গেল ভোটের প্রচারে পথে-প্রান্তরে।

অনেক জায়গাতেই ভিড়ের মধ্যে শোর শোনা গেল- “নিতা আইছে, আমাগের নিতা আইছে রে।”