“আগে যা কামাইতাম, মোটামুটি চলত। এখন কামাই একই রকম আছে। কিন্তু, খরচ বাড়ছে। অনেক কষ্টে চলতে হয়।”
Published : 07 Jan 2025, 01:35 AM
একটি অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া মাংসের কোরমা আর ঝোলে মাখামাখি হওয়া পোলাও নিয়ে মহাখালী কাঁচাবাজার সামনে বসে বিক্রি করছিলেন একজন। সেখানে একজন ক্রেতা পোলাও দরদাম করছেন; কথা বলে জানা গেল, পেশায় তিনি দিনমজুর।
কেন দারদাম করছেন এই খাবার, প্রশ্ন করতেই অসহায়ত্ব ঝরে পড়ে জহির উদ্দিন নামের এই ব্যক্তির কণ্ঠে।
“পরিবার নিয়া আমি থাকি কড়াইলে। ওইখানে ২ বছরে দুই বার ঘর ভাড়া বাড়ছে। রোজগার তো বাড়ে নাই। দুইটা ছোট-ছোট বাচ্চা আছে। খরচ শুধু বাড়েই। বহুদিন গরুর মাংস কেনা সম্ভব হয় না। এখানে দেখে একটু কম দামে পাওয়া যায় বলে মাংসের কোরমা কিনতে চাইতেছিলাম।”
সেদিন বৃহস্পতিবার। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে দেখা গেল লম্বা লাইন। সেখানে কথা হয় ৬০ বছরের রহিমা খাতুনের সাথে। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও কিছুই পাননি তিনি।
আক্ষেপ করে সাততলা বস্তির এই বাসিন্দা বলেন, “কয়ডা ট্যাকা বাঁচানের লাইগা খাড়াইছিলাম। কিন্তু, মাল শেষ। তিন কূলে কেউ নাই আমার। স্বামী নাই, পোলা-মাইয়াও নাই। যেই দাম জিনিসপত্রের, চলতে পারি না।”
তেজগাঁও শিল্প এলাকার রিকশাচালক ওমর ফারুকের গল্পটাও একইরকম।
“আগে যা কামাইতাম, মোটামুটি চলত। এখন কামাই একই রকম আছে। কিন্তু, খরচ বাড়ছে। অনেক কষ্টে চলতে হয়। জমানের (সঞ্চয়ের) প্রশ্নই আহে না।”
প্রায় এক বছর ধরেই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট মানুষের মানুষের জীবন। বছর জুড়েই কোনো কোনো পণ্যের দাম থাকছে লাগামছাড়া। কখনও আবার বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে কোনো নিত্যপণ্য।
মানুষের কষ্ট যে বেড়েছে, সেটি উঠে এসেছে বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও। সবশেষ বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে তিন ধাপ নেমে ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চুরাশিতম অবস্থানে রয়েছে।
সূচকে বাংলাদেশের এবারের স্কোর ১৯ দশমিক ৪। এই স্কোর নিয়ে এই স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন মাঝারি মাত্রার ক্ষুধাবৃত্তে রয়েছে। আগের বছর ১৯ স্কোর নিয়ে এ সূচকে বাংলাদেশ ছিল ৮১তম স্থানে।
ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের তৈরি করা এই প্রতিবেদন বলছে, দেশের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অপুষ্টির কারণে থমকে গেছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টির শিকার এবং ২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর বয়স ৫ বছর হওয়ার আগেই মারা যায়। অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থাৎ বয়সের অনুপাতে তাদের উচ্চতা বাড়ছে না। আর অপুষ্টির জন্য পাঁচ বছরের কম বয়সী ১১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ উচ্চতার অনুপাতে তাদের ওজন বাড়ছে না।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে ৯ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অগাস্টের বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় ৩৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
প্রতিবেদন আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৩০ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে এবং ৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া ২৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ কমিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২১০০ কিলোক্যালরি) নিতে হয়, তাতে প্রতি মাসে খরচ হওয়ার কথা ১৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটাকেই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
ডব্লিউএফপির গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক হিসাব বলছে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার নিতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু খরচ করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার নিতে একজন মানুষের খরচ হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বারবার সুদের হার বাড়ানো হলেও সুফল মিলছে না নিত্যপণ্যের বাজারে; চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরেও ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে পৌঁছায়। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশের কাছাকাছি।
অন্যদিকে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির সবশেষ হার হল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। প্রায় প্রতি বছরই মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকে।
সরকারি পরিসংখ্যানে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি না বাড়ায় গত দুই বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) আয়োজিত এক কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. দীন ইসলাম এই তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, দুই বছরে ৭৮ লাখ ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে সহনীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। একই সঙ্গে ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। এ সময়ে নতুন করে ৩৮ লাখ মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্রতে নেমে এসেছে।
তবে এই গবেষণা করতে মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপ করা হয়নি, মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির গড় হার বিবেচনায় এই হিসাব করা হয়েছে। গবেষণার এ প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্য সীমা এবং অতি দারিদ্র্য সীমার ক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতাকে বেছে নিয়েছে।
সরকারের দেওয়া বিবিএসের তথ্যেই মূল্যস্ফীতি এবং প্রকৃত মজুরির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ৬ শতাংশের বেশি মানুষ তাদের ক্রয় ক্ষমতা ‘হারিয়েছে’। এর ফলে তারা নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিবিএসের সবশেষ হিসাবে দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
সবশেষ প্রতিবেদনে ২০২২ সালে দেশে অতি দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা ২০১৬ সালে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে সরকারের ‘ভুল নীতিকে’ দায়ী করেন দীন ইসলাম। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এক বছরেই এক লাখ কোটি টাকা ঋণ বা টাকা ছাপিয়ে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা আবাসিক কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতিটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এই পর্যায়ে তো ইদানিংকালে আর দেখা যায়নি। ওইটাকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে এই পরিস্থিতি উত্তরণের উপায়গুলো অনেক সীমিত হয়ে যায়।
“কারণ, বিকল্প এগুলো তো নিম্নআয়ের পরিবারগুলোরই চিত্র। তো, তাদেরকে বাজেটের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া বাড়াতে হবে, যাতে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে পারে, কমাতে পারলে তো সমস্যাটা ওখানেই সমাধান হয়ে যেত।”
খাদ্যের মূল্য এবং স্ফীতি দুটোই কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “মূল্যবৃদ্ধির হার কমলে তো যথেষ্ট হবে না। কারণ, মজুরি তো বাড়ছে না। গত ৩৬ মাসের বেশি হয়ে গেল, মূল্যস্ফীতি যে গতিতে বেড়েছে, মজুরি বৃদ্ধির হার তার চাইতে অনেক পেছনে। কৃষি, সেবা, শিল্পখাত, সবক্ষেত্রেই।
“দক্ষ মজুর যারা আছে, এদের মজুরি কোথাও মূল্যস্ফীতিকে হার মানাতে পারেনি। দুই শতাংশ পয়েন্ট, তিন শতাংশ পয়েন্ট পেছনে। মূল্যস্ফীতি যেখানে ৯, ওদের বৃদ্ধির হার হয়ত ৬ শতাংশ। নিম্নআয়ের পরিবারে খাদ্য মূল্য কমাটা স্ফীতি কমার মত সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”
ভাতার আকার এবং আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “যে কর্মসূচিগুলো আছে, নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য, এগুলোতে যে বরাদ্দটা দেওয়া আছে, সে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। মানে, ভাতা, আওতা দুইটাই বৃদ্ধি করা দরকার।”
দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যেটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে যে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা, যা অতীতে আমরা দেখেছি, যার কারণে যাদের উদ্দেশ্যে সহায়তাটা দেওয়া হত, বেশিরভাগই তাদের কাছে পৌঁছাত না।
“এটা ফ্যামিলি কার্ড সিস্টেম বলেন বা ক্যাশ সহায়তা প্রদানে যে সমস্ত কর্মসূচি সামাজিক সুরক্ষা খাতে আছে, স্বাস্থ্য খাতে আছে, শিক্ষা খাতে আছে, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিছু কর্মসূচি আছে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিছু কর্মসূচি আছে, সবগুলোর টার্গেটই হলো নিম্নআয়ের দরিদ্র পরিবারগুলো। কিন্তু, টাকাটা যায় অন্য জায়গায়। ওই ব্যবস্থাপনার উন্নতি, যাতে যাদের উদ্দেশ্যে সহায়তাটা দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছে পৌঁছানো যায়। একদিকে আপনার খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার সক্ষমতাটা বাড়াতে হবে।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে মানুষের হাতে অর্থ আসে, সেই অর্থ দিয়ে বাজার থেকে জিনিস কিনতে পারে।
“যারা দরিদ্র, কাজ করতে পারবে না, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা লাগবে। এটার আওতা বাড়াতে হবে, টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। ওএমএস, টিসিবির পরিমাণ বাড়াতে হবে। সংখ্যা বাড়াতে হবে। কারণ, দেখি তো লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে তো সবাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছে না।”
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এখন অর্থ থাকলেও সবাই সব কিছু কিনতে পারছে না। যেহেতু, মূল্যস্ফীতির চাপ অত্যন্ত বেশি। বেড়েই চলেছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনা।”
পুরনো খবর
মূল্যস্ফীতি: দুই বছরে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে 'পৌনে দুই কোটি মানুষ'