পুলিশ সদস্যদের ভাষ্য, শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি বলে তাদেরকে বুঝেশুনে চলতে বলা হয়েছিল। তবে বিক্ষোভে হঠাৎ ‘অছাত্র গোছের’ ব্যক্তিরা যোগ দিয়ে শুরু করে সহিংসতা।
Published : 26 Jul 2024, 01:34 AM
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ঢাকার প্রগতি এলাকায় দায়িত্ব পালন করা গুলশান থানার একজন এএসআই বলছিলেন, “বৃহস্পতিবার (জুলাই ১৮) সকালে আমরা যখন বাড্ডায়, তখনও স্যাররা কইতেছিল, ওই পোলাপাইন দেইখা মারিস। কারও গায়ে যেন না লাগে।”
তবে পরিস্থিতি এমন থাকেনি। সংঘাত ছড়িয়ে পাঁচটি দিন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অনেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় গোটা দেশে।
সেদিন সকালে ঢাকায় মূলত দুটি জায়গাতে সংঘাত শুরু হয়। এর একটি হল উত্তরা এবং একটি হল বাড্ডা এলাকা। দুই এলাকাতেই প্রাণহানি ঘটে এবং পরে তা ছাড়িয়ে যায় দেশের নানা প্রান্তে।
এই সংঘাতের মধ্যে দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়, হামলা হতে থাকে একের পর এক রাষ্ট্রীয় স্থাপনায়। ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় পরের কয়েকদিন তৈরি হয় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, বাড়তে থাকে মৃত্যু, জারি হয় কারফিউ।
যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুরে প্রায় চার দিন ধরে চলে সংঘর্ষ, সব মিলিয়ে দুইশর কাছাকাছি মৃত্যু এবং এক হাজারের বেশি পুলিশের আহত হওয়ার খবর এসেছে।
পুলিশ বলছে, সেদিন সকালে শুরুর দিকে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করা গেছে। কিন্তু বেলা গড়ানোর পর পর তাদের সঙ্গে অন্য অনেকে আসতে থাকে, যারা ছাত্র নয় বলেই মনে হয়েছে। তখন থেকে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, উচ্ছেদ হওয়া হকার, বস্তিবাসীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজনও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। অনেক জায়গায় কিছু লোকজন এসেছিলেন শুধু লুটপাট করার জন্য।
বাড্ডায় কী হয়েছিল
সেদিন বাড্ডার প্রগতি সরণিতে দায়িত্ব পালনকারী একজন এসআই বলেন, “বিষ্যুৎবার সকালেও আমাদের কোন ধারণা ছিল না কীসের ভিতরে যাইতাছি। স্যাররা ব্রিফ করছে পোলাপাইনের আন্দোলন, দেইখা-শুইনা চলতে হইব। আমাগোও পোলাপাইন আছে, সব মিলায়া মাঠে গেলাম।
“সবারই হেলমেট, বুলেটপ্রুফ লাগানো আছিল। আগেরদিন বুধবারে আমাদের ফোর্স মহাখালী রেলগেটে ভালো মাইর খাইছে, পুলিশ বক্স পুড়াইছে। আমাদের প্রস্তুতি ছিল মব কন্ট্রোলের। কিন্তু এইখানে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হইছে।”
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সেদিন আশেপাশেই ছিলেন। সকালের দিকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে মিছিল শুরু করে।
সেই এসআই বলেন, “কয়টা বাজে খেয়াল নাই, পোলাপাইন রাস্তা আটকাইছে। আমাদের লোক তাদের সঙ্গে কথাও কইছে। হঠাৎ করে কিছু লোকজন আইসা এমন জঙ্গিপনা শুরু করল যে হয় আমাগো গুলি করা লাগে নাইলে পলানো ছাড়া উপায় নাই।
“আমরা টিয়ার গ্যাস মারলে হ্যারা উল্টা আমাগো দিকে মারে। রাবার বুলেট তো বেশি দূর যায় না। পরে স্যাররা বললো, সীসা মারতে (শটগানের ধাতব ছররা গুলি)। সীসার রেঞ্জ বেশি। আমরা সীসা মারা শুরু করলাম। ওরা রাস্তা ছাইড়া প্রথমে পলাইল। পরে কোইত্থিকা এক বিরাট প্লাস্টিকের ব্যানার নিয়া আইসা ঢাল বানাইল, সেইটার পিছে খাড়াইয়া সবাই ঢিল মারতাছে সমানে। গুলতি দিয়া পাথরও মারছে প্রচুর।
“এত ইট-পাথর মারামারি হইছে আমরা আর খাড়াইতে পারি না। সব জায়গাতেই একই অবস্থা। যে যার মত সেফ সাইড হইতাছে। এর মধ্যে শুনি আমাদের ডিসি স্যারসহ সিনিয়র স্যাররা বিল্ডিংয়ে আটকা পড়ছে। ওই সময় আমাদের আর দাঁড়ানোর মতো অবস্থা ছিল না। সেইফ সাইডে থাইকা গ্যাস, গুলি মাইরা কোন রকমে ঠেকানোর চেষ্টা করতাছিলাম।”
সেই সংঘাত আর থামেনি। ফলে পুলিশ সদস্যদের আর কর্মঘণ্টার হিসেব ছিল না।
বাড্ডা থানার একজন এএসআই বলেন, “রাইতে কই থাকুম কুনো ঠিক নাই। কোন বিল্ডিংয়ের নিচে বা ফাঁড়িতে গাদাগাদি কইরা অনেক লোক আছিলাম। খাওয়ারও কোনো ঠিক ঠিকানা আছিল না। আমাগো লগে এডিসি স্যার, এসি স্যার। পোলাইপাইন (কনস্টেবল) কেউ কেউ বিড়ি খায়, বারবার এই কোণা- সেই কোণায় বিড়ি খাইতে যায়, স্যারগো সামনে খাইতে পারে না তো। পরে স্যাররা আইসা বিড়ির প্যাকেট হাতে দিয়া কইছে, ‘তোরা এইখানেই খা, তবুও বাইরে যাইস না’।”
কেবল ১৮ জুলাই না, পরের দুই দিনও রামপুরা বাড্ডায় বিক্ষোভ চলে। পুলিশের ভাষ্য, সেখানে বেশি ছিল অছাত্ররেই।
বাড্ডার সেই এএসআই বলেন, “এই দাঙ্গাকারীরা গুলশানে ঢুকতে পারলে আশপাশের ‘সেনসিটিভ’ সব জায়গা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিত, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া পড়ে যায়।”
গুলশান-বনানী থেকে যে হকারদের উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারাও সেখানে ছিল বলে তথ্য পেয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বলেন, “কে বা কারা এদের নাড়িয়েছে সেটা এখন আমরা খোঁজ নিয়েছি। আবার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকেরাও রাস্তায় নেমেছিল। আমরা তাদের নিশ্চয়ই খুঁজে বের করব।”
সেদিন দুপুরে বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ভবন থেকে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করে র্যাব।
বিমানবন্দর সড়কে বিক্ষোভের সময় ‘নেতা গোছের’ ওরা কারা?
গুলশান বিভাগের একটি জোনের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা বলছেন, এই অঞ্চলে ভালো রকম শিক্ষার্থী জমায়েত হবে এ রকম একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন আগেই ছিল। তাই তারাও প্রস্তুত ছিলেন।
এই শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেছিল, পুলিশ কর্মকর্তারা তাদেরকে বিদেশগামীদের সমস্যার কথা বোঝালে তারা সরে যেতেও রাজি হন। পরে ‘ডানপন্থি’ নেতা গোছের কয়েকজন ঝামেলা পাকায়, বলছেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার পদের এই কর্মকর্তা বলেন, “ওইদিন হয়ত বেলা ১১টা নাগাদ কাকলী-বনানী এলাকায় মাঠে নামল আশপাশের কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। তারা দীর্ঘক্ষণ এয়ারপোর্ট রোডটা বন্ধ করে বসে রইল। এর মধ্যে ওপর থেকে স্যাররা বললেন, ওরা আন্দোলন করছে করুক, কিন্তু এয়ারপোর্ট রোডটা ক্লিয়ার করতে হবে।
“নির্দেশনা পেয়ে বেলা ২টার পর ওখানে গেলাম ফোর্সসহ। ছেলে-মেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে, আন্দোলন করছে- তবে তারা অনেক নমনীয়। ওদের নেতা গোছের কয়েকজনকে ডেকে আমরা কথা বললাম। বললাম, ‘তোমরা আন্দোলন করতে চাও কর, কিন্তু এয়ারপোর্ট রোডটা ছেড়ে দাও। বহু মানুষ ফ্লাইট মিস করবে, রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাইরেন বাজাচ্ছে, রোগীরা গাড়ির ভেতরে ধুঁকছে।’
“এসব কথা বলার পর ওরাও বুঝল। ওরা বলল, ‘ভাইয়া আমাদের ১০টা মিনিট সময় দেন আমরা রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছি।’ কিন্তু ওরা (নেতা গোছের) যখন ওদের জমায়েতের ভেতর ঢুকল, তখন দেখলাম কয়েকজন ওদের কথা শুনছে না, তারা বলছে রাস্তা ছাড়বে না।”
এই পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, যারা রাস্তা না ছাড়ার পক্ষে ছিল তাদের দেখে ডানপন্থি বলে মনে হয়েছে তার।
তিনি বলেন, “পরে আবার আমরা গিয়ে কথা বললাম, তারা রাস্তা ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল- ফোর্স মুভ করবে। বাঁশি বাজিয়ে ধাওয়া দিলাম আমরা। কয়েকজন এদিকে-ওদিক ছুটে গিয়ে ইট মারল, কিন্তু পরে আর রাস্তায় আসেনি ওরা।”
এরপর মহাখালীতে অবরোধের কথা জানতে পারেন এই সহকারী কমিশনার।
তিনি বলেন, “আমরা মহাখালী এসে দেখলাম আন্দোলনকারীরা রেললাইনের ওপর, অদূরে কমলাপুরগামী একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে। আমরা তাদের সেখান থেকে সরানোর চিন্তা করে কেবল পুলিশ বক্সে ঢুকেছি, এসময়ই আমাদের আরেকটা টিম উত্তর দিক থেকে (আমতলী) হেঁটে আসার সময় তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে বৃষ্টির মতো পাথর মারা শুরু করল।
“রেললাইনের বড় বড় পাথরে ফোর্স ও অফিসারদের অনেকেই আহত হলেন। ফোর্স কোণঠাসা হয়ে গেল। পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই মিরাজসহ কয়েকজন আটকা পড়লেন বক্সের ভেতরেই। চারদিক ঘিরে আন্দোলনকারীরা। এক পর্যায়ে কৌশল করে তাদের সেখান থেকে বের করা হয়। এরপরই আন্দোলনকারীরা আগুন দেয় পুলিশ বক্সে, পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়।”
এরপর দুই ঘণ্টা সেখানে সংঘর্ষ হয়।
“তখনো আমরা কেবল গ্যাস মেরে, রাবার বুলেট ছুঁড়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছি। আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থী এই চিন্তা আমাদের সবার মনেই ছিল। কিন্তু শুধু গ্যাস দিয়ে তাদের সঙ্গে টেকা গেল না। আমরা পরে বাড়তি ফোর্স আনিয়ে তাদের সরাতে পেরেছি, তাও দুই ঘণ্টা পর।”
পুলিশ সরতেই সরকারি স্থাপনায় হামলা, ছিল ‘প্রশিক্ষিতরা’
বাড্ডা-রামপুরা রোড দখলে নেওয়ার পর বিক্ষোভকারীরা গুদারাঘাট দিয়ে গুলশানের দিকে আসার চেষ্টা করতে থাকে। পুলিশ তখন তাদেরকে থামাতে চেষ্টা করে।
“এরমধ্যেই খবর পেলাম থানায় হামলা হতে পারে। আমরা সেদিকে মনোযোগ দিলাম। থানা ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হল।
“আমাদের গুলশান বিভাগের পুলিশের মনোযোগ ছিল ওরা যেন গুলশানে ঢুকতে না পারে। এক পর্যায়ে এখানেও আমাদের গুলি ছুঁড়তে হয়েছে।”
এরমধ্যেই বিকেলের দিকে তারা মহাখালী ফাঁকা পেয়ে দুর্যোগ ভবন, সড়ক ভবন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আগুন দেওয়া হয়।
“আমরা কোনো জায়গা থেকে সরে গেলেই সেখানে একটা আগুন দিয়ে পালায় ওরা”, বলেন সেই সহকারী কমিশনার।
সেদিন আক্রমণের ধাঁচ দেখে এই কর্মকর্তা বলেন, “কিছু ট্রেইনড লোক, যাদের কাছে ম্যাপ করা ছিল কোন কোন স্থাপনায় হামলা করা হবে। তারা হাতে করে পানির বোতলে তেল (পেট্রোল) এনেছিল, কেউ আবার আনে পোটলার মত করে গান পাউডার। যার কারণে খুব অল্প সময়ে তারা অনেকগুলো জায়গায় আগুন দিতে পেরেছে।”
আশপাশের বস্তির কিছু ছেলে তাদের সঙ্গে জুটে যায়, পুলিশের ভাষ্য, ‘যাদের মূল টার্গেট ছিল এসব জায়গা থেকে নাশকতার সময় লুট করা। এরা প্রচুর জিনিসপত্র লুটও করেছে।
থানা রক্ষার ‘যুদ্ধ’
মোহাম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ড থেকে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড় কেন্দ্রিক যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তা ১৮ জুলাই শুরু হয়ে চলে ২১ জুলাই পর্যন্ত।
মোহাম্মদপুরের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “হঠাৎ করেই রাত ২টায় মনে হল সারাদিন কিছু খাইনি। সঙ্গে থাকা সঙ্গীরাও খাওয়ার কথাও মুখে তুলেনি। পরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে খাবার খোঁজ করতে গিয়ে কোনো হোটেল খোলা না পেয়ে পরিচিত একজনকে ২০ জনের খাবার তৈরি করতে বলি। সেই খাবার যখন আসে তখন ভোর ৪টা।
“প্রায় ২০ ঘণ্টা পর সেদ্ধ ডিম আর সাদা ভাত খেয়ে কিছুটা বিরতির পর আবার অস্ত্র হাতে সেই ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে হয়েছে।”
এসআই পদ মর্যাদার ওই পুলিশের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করলেও মোহাম্মদপুরে প্রায় প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে জানান ওই বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার রওশনুল হক সৈকত।
তিনি বলেন, “আমি তো বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে যে পোশাক পরে বের হয়েছি সেটি শনিবার রাতে গিয়ে খুলেছি।”
মোহাম্মদপুরের বছিলা- তিন রাস্তার মোড়ভিত্তিক আন্দোলনটা বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত টের পায়নি পুলিশ। বুধবার আসাদ গেট মোড়, আড়ং এর সামনে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। পরে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের দিকে এগিয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। সেখানেই তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে পুলিশের। দুপুরে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
অতিরিক্ত উপ কমিশনার রওশনুল হক সৈকত জানান, “হঠাৎই খবর আসে একদল উচ্ছৃঙ্খল লাঠিসোঁটা নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার দিকে আসছে। সে সময় থানায় মাত্র ৭ জন পুলিশ সদস্য ছিল। তারাই সেই জনতাকে সামাল দিতে গিয়ে একবারে হিমশিম খেয়ে যায়। ফাঁকা গুলি করতে গিয়ে তাও শেষ হয়ে যায়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে হামলাকারীদের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নেওয়া হয়।“
হঠাৎ করে মোহাম্মদপুরে এত উচ্ছৃঙ্খল জনতা দেখে হতভম্ভ পুলিশের এই কর্মকর্তা।
বিকাল থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, আল্লাহ করিম মার্কেট এলাকা থেকে সংঘাত ছড়ায় বছিলা পর্যন্ত।
থানা ছাড়াও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পুলিশ ফাঁড়ি, বছিলায় ডিএমপির পুলিশ লাইন, এসপিবিএন এর ৫টি ব্যারাক এবং র্যাব-২ কার্যালয় হামলাকারীদের মূল টার্গেট ছিল বলে মনে করে পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে এসব স্থাপনায় শেষ পর্যন্ত কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।
তাদের হামলা এতটাই তীব্র ছিল যে মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের সেখান থেকে সরে আসার জন্য বলাও হয়েছিল।
পুলিশ কর্মকর্তা রওশনুল হক সৈকত বলেন, “ফাঁড়িটি শেষ পর্যন্ত চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। পরে তাদেরকে অস্ত্র এবং মূল্যবান জিনিস নিয়ে সরে যেতে বলা হয়। তারা যদি আগুন ধরিয়ে দেয় তাহলে স্থাপনাওটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্য কিছু নয়।”
ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ রেজাউল করিম বলেন, “তারা ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র সরিয়ে নিলেও তাদের যে জনবল আছে সেটি দিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে টানা দুইদিন ‘যুদ্ধ’ করি।
“এই ফাঁড়ি ঘিরে ৬টি গলির মুখ আছে। প্রতিটি মুখ থেকে শত শত জনতা ইটপাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে। সন্ধ্যার পর শুরু ১৭ জনকে নিয়ে প্রতিরোধ চলে শুক্রবার পর্যন্ত।”
পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, উচ্ছৃঙ্খল জনতার পুলিশের এইসব স্থাপনা হামলা চালিয়ে অগ্রসর হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন পর্যন্ত আসার পরিকল্পনা ছিল।
রেজাউল জানান, খাবার সংকট ছিল ভয়াবহ। রাত বৃহস্পতিবার রাতে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে জানালেন কয়েকজন সদস্যের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে কোনো খাবার আসেনি, তাছাড়া ঘটনাস্থল থেকে তারা যেতেও পারছিলেন না।
পরে জেনেভা ক্যাম্পে একজনকে ফোন করে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা সংলগ্ন তিন রাস্তা মোড় পর্যন্ত টানা দুইদিন ‘সম্মুখ যুদ্ধে’ ছিলেন মোহাম্মদপুর থানার এক কনস্টেবল।
তার ভাষ্য, যে ঘটনা ঘটেছে অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি কখনও হননি।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঞা বলেন, ১৬ থেকে ১৯ জুলাই এক পোশাকে কাটিয়েছেন। থানায় গেলেও বসার সুযোগ পাননি।
টার্গেট করে পুলিশকে হামলা
পুলিশের গুলশান বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, “তারা (বিক্ষোভকারী) টার্গেট করে পুলিশ খুঁজেছে। বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মোবাইল চেক করেছে তিনি পুলিশ কি না এটা বোঝার জন্য।
“বনানী থানার এসআই তকিফুল ইসলামের পরিবারে একজন অসুস্থ ছিলেন। শুক্রবার রাতে চারদিকে সংঘাতের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে সাদা পোশাকে কর্তব্যস্থল গুলশান এলাকা থেকে সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে পল্লবী এলাকায় ভাড়া বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেন।
“পল্লবীতে এলাকায় ঢোকার পর দাঙ্গাকারীরা তাকে আটক করে বেদম মারধর করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় আলোক হেলথকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। এসআই তকিফুল এখন ভর্তি আছেন আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে।”
রিকশায় করে সাদা পোশাকে অফিসে যাওয়ার সময় ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে হামলার শিকার হন ট্যুরিস্ট পুলিশের এক এসআই। তার রিকশা আটকে তল্লাশি চালিয়ে তিনি পুলিশ তা বুঝতে পেরে মারধর করা হয় তাকে। মারধর করে তার মাথা থেঁতলে দিয়ে হত্যা করা হয়।
পুলিশের হিসেবে সংঘাতময় পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সারা দেশে বাহিনীটির ১ হাজার ১১৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩২ জন গুরুতর, মারা গেছেন তিনজন। আইসিইউতে আছে আরও তিনজন।
সারা দেশে পুলিশের থানা, ফাঁড়িসহ ২৩৫টি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের তথ্য দিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যানসহ ২৩৬টি যানবাহনে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাই থেকে চারদিন ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যদের সার্বক্ষণিক বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হেলমেটসহ রায়ট গিয়ার পরে থাকার নির্দেশনা মানতে হয়েছে।
আরও পড়ুন:
রামপুরায় পুলিশ সদস্যের বাসা খুঁজে বের করে হামলা: ডিএমপি
এভাবে ধ্বংস মানতে পারছি না: প্রধানমন্ত্রী