মঙ্গলবারের নির্বাচনে ট্রাম্প যদি জিতে যান, সেটা হবে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা।
Published : 05 Nov 2024, 02:08 PM
আট বছর আগে ডনাল্ড ট্রাম্প যেবার প্রথম নির্বাচনে দাঁড়ালেন, বিশ্বের খুব কম লোকই সেবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিপরীতে তার নামে বাজি ধরেছিলেন।
কিন্তু ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্পের’ বছর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই সময়ে ট্রাম্প ভূমিকম্পের মতই নতুন যুগের সূচনা করে ক্ষমতায় আসেন ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান নিয়ে।
বিশৃঙ্খলা আর ঘরে-বাইরে সমালোচনার মধ্যে চারটি বছর হোয়াইট হাউজে কাটিয়ে ২০২০ সালের নির্বাচনে চরম নাটকীয়তার মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প, যদিও সেই পরাজয় তিনি কখনো মেনে নেননি।
ওই নির্বাচনের পর ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা চিহ্নিত হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কুখ্যাত এক অধ্যায় হিসেবে। মনে হচ্ছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়ত সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু চার বছর পর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তনে আবারও ভোটের মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। আবারও হোয়াইট হাউজের দখল নিতে মরিয়া লড়াইয়ে নেমেছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প।
বিবিসি লিখেছে, মঙ্গলবারের নির্বাচনে ট্রাম্প যদি জিতে যান, সেটা হবে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রে পরাজিত প্রেসিডেন্টের ফের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড আছে কেবল গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১৮৯২ সালে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ব্রায়ান লাঞ্জার ভাষায়, সত্যিই যদি সেরকম কিছু ঘটে যায়, তাহলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, কারণ একবার পরাভূত হওয়ার পর দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন।
হোয়াইট হাউজে চার বছর
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর কখনও মিসাইল ছুড়ে, কখনও উল্টোপাল্টা কথা বলে, কখনও টুইট করে, মিথ্যা বলে, অবস্থান বদলে- অসংখ্যবার বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট ট্রাম্পের ওই সব কীর্তিকলাপের হিসাবও রেখেছে।
হোয়াইট হাউসে আস্তানা গাড়ার পর থেকে দেশের ভেতরে -বাইরে অনেক ওলট-পালট ঘটিয়ে দেন তিনি। এক মেয়াদের মধ্যেই তিনির চিফ অব স্টাফ বদলেছেন একাধিক। প্রেস সেক্রেটারি, উপদেষ্টা- কখন যে কে পদত্যাগ করছেন, কাকে যে ট্রাম্প বরখাস্ত করছেন, তা নিয়ে খাবি খেতে হয়েছে বিশ্বের গণমাধ্যমকে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেকের দিন থেকে বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু তাতে দমবার পাত্র নন ট্রাম্প। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে সারাক্ষণই তটস্থ রেখেছিলেন তিনি।
কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শুরু, এরপর একে একে ওবামাকেয়ার বাতিল, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর অভিবাসনপ্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে বাধা, সরকার অচল, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উসকে দেওয়া, উগ্র ডানপন্থা সমর্থনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প আমেরিকান সমাজের ভেতরকার অনুঘটকগুলোর রূপ বদলে দেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিতও হয়েছিলেন তিনি। যদিও মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সেনেট রিপাবলিকানদের দখলে থাকায় পদ হারাতে হয়নি তাকে।
২০১৬-র নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত নিয়ে তদন্ত, ট্যাক্স রিটার্ন প্রকাশসহ বেশ কিছু বিষয়ে বিরোধীরা সত্তরোর্ধ এ প্রেসিডেন্টকে বেশ ভোগালেও প্রতিবারই পিছলে যেতে পেরেছেন তিনি।
আমেরিকাকে ‘শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট’ পরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসা ট্রাম্প চার বছরে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেওয়া থেকে শুরু করে আগ্রাসী প্রশাসনিক নীতি নেওয়া, বাগদাদে ড্রোন হামলায় কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সোলেমানি হত্যা, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া, চীনসহ নানা দেশের অসংখ্য পণ্যে একের পর এক শুল্কারোপ, তেলের দামের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে বিতর্কিত অবস্থান নিয়ে মেয়াদের প্রায় পুরো সময়ই ‘স্পট লাইট’নিজের দিকে টেনে রেখেছিলেন।
কিন্তু মেয়াদের শেষ বছর ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন তিনি। ওই মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়।
পতন
ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও রিপাবলিকান প্রার্থী হয়েছিলেন ট্রাম্প। এই বছর করোনাভাইরাস মহামারী যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজের ভূমিকা ও বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
পরে ওই বছরের অক্টোবর মাসে নিজেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। তখন নির্বাচনী প্রচার থেকে কিছুদিন দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হন ট্রাম্প। বাইডেন ৩০৬ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন। ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২ ইলেকটোরাল ভোট।
বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট।
কিন্তু বাইডেনের এই জয় মেনে নিতে পারেননি ট্রাম্প। ভোটে হারার পর থেকে ভোট চুরি ও নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলতে থাকেন তিনি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ৬০টির বেশি মামলা দায়ের হলেও আদালত সেগুলো খারিজ করে দেয়।
নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করা ট্রাম্প ২০২১ এর ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের কাছে সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন। ওই দিন ক্যাপিটল ভবনে বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণা করতে মার্কিন কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশন ছিল। ট্রাম্প তার সমর্থকদের ক্যাপিটল ভবনে যাওয়ার ডাক দেন।
ট্রাম্পের সমাবেশ থেকে তার কয়েক হাজার সমর্থক গিয়ে ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায়। সেখানে দাঙ্গায় ছয়জনের মৃত্যু হয়। এর ফলে ট্রাম্প দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হন। তবে এবারও সেনেটে রিপাবলিকান আধিপত্যের কল্যাণে রেহাই পান তিনি। তবে ওই ঘটনা নিয়ে তার বিরুদ্ধে এখনও দু’টি ফৌজদারি মামলা ঝুলছে।
ফের ভোটের লড়াই
ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাতে ধরে নেওয়া হয়েছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে। তার অনেক দাতা ও সমর্থক আর কখনও ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও অনুসারীদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বজায় থাকে। সমর্থকরা তার লড়াকু মনোভাব ও মনে যা আসে তা স্পষ্ট করে বলাকে তার সততা ও সাহসের নজির বলে মনে করেন। প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকানরা যাই বলুক দলের কর্মীদের মধ্যে তার প্রভাব ব্যাপকভাবেই বজায় থাকে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই জনমনে আলোড়ন তোলার মত একটি ঘটনা ঘটে। ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প তিনজন ডানপন্থি বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে মনোনীত করেছিলেন। তাদের নিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয় আর এ সুযোগে তারা দেশটিতে ৫০ বছর ধরে জারি থাকা গর্ভপাতের অধিকারের অবসান ঘটান।
এরপর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলের জন্য ট্রাম্পকেই দায়ী করা হয়। ফৌজদারি অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হওয়া প্রথম সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং দুইবার অভিশংসনের মুখোমুখি হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট হলেও ২০২৪ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী হওয়ার জন্য আবার মাঠে নামেন ট্রাম্প।
শক্ত কোনো বাধা ছাড়াই দলের মনোনয়ন দৌঁড়ে অন্য রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্রুত ধরাশায়ী করে ফেলেন তিনি। অনেকেই তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে তার বিরুদ্ধে তোপ দাগাতে শুরু করেন ট্রাম্প। চারটা ফৌজদারি মামলায় ৯১টি গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনী দৌঁড় শুরু করলেও মামলা বিলম্বিত করার কৌশল নিয়ে অনেকটা সফল হন তিনি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনটি মামলায় আর অগ্রগতি হবে না। যুক্তিগতভাবে সবচেয়ে দুর্বল অভিযোগের ভিত্তিতে নিউ ইয়র্কের আদালতের দেওয়া সাজাও নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনী জনসভায় হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যান ট্রাম্প। আততায়ীর গুলি তার ডান কান চিরে বেড়িয়ে যায়।
দুই মাসের মাথায় ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ট্রাম্প যখন নিজের গল্ফ কোর্সে খেলছিলেন, তখন আবার তাকে হত্যার চেষ্টা হয়। তবে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিক্রেট সার্ভিস সেই হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।
এসব ঘটনায় সহানুভূতি পেয়েছেন ট্রাম্প, তাতে তার জনপ্রিয়তার পারদ আরো উঠেছে।
এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনই প্রাথমিকভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন। যতদিন বাইডেন নির্বাচনী মাঠে ছিলেন ততদিন ট্রাম্পর তুলনায় তিনি অত্যন্ত দুর্বল প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিলেন।
পরে বাইডেনকে সরিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করে ডেমোক্রেটিক পার্টি। তাতে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জাতীয় জনমত জরিপগুলোতে জনসমর্থনে হ্যারিস এগিয়ে যান, কিন্তু নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আসা সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের জনসমর্থনও বাড়তে থাকে। এখন জনসমর্থনের বিচারে দুই প্রার্থী প্রায় সমান সমান অবস্থানে আছেন। তাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে সবগুলো জনমত জরিপ।
সব বাধা পেরিয়ে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজের দখল নিতে পারবেন কি-না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকদিন।
ধনকুবের থেকে রাজনীতিবিদ
এ মুহূর্তে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে জোর প্রচারে ব্যস্ত ট্রাম্প। এসব অঙ্গরাজ্যে নিজের পক্ষে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিসের তীব্র সমালোচনা করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছেন না তিনি।
অথচ ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ট্রাম্পকে চিনত দেশটির সবচেয়ে রঙদার, জাঁকালো এক ধনকুবের হিসেবে। ব্যবসায়ী ট্রাম্প যে সত্তর পেরিয়ে এসে আমেরিকার রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে আবির্ভূত হবেন, সেসময় কয়জনই তা ভেবেছিল!
রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী আর অধিকারকর্মীদের এতটা অনাস্থা নিয়ে, একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ সামাল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব কি-না, ছিল সে প্রশ্নও।
নিউ ইয়র্কের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ফ্রেডরিক ট্রাম্পের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডনাল্ড; ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন নিউ ইয়র্কের কুইন্সে তার জন্ম।
বাবা ফ্রেডরিক কুইন্স, স্টাটান আইল্যান্ড আর ব্রুকলিন এলাকায় সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বানাতেন। অভিবাসীবিরোধী ইমেজ গড়ে তোলা ট্রাম্পের মা একজন স্কটিশ বংশোদ্ভূত; ছুটিতে নিউ ইয়র্ক বেড়াতে এসে ফ্রেডরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার।
ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও ছোটবেলায় বাবার প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন-স্তরে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ডনাল্ড। ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি পান উদ্যমী আর আগ্রাসী হিসেবে। স্কুলে বেয়াড়াপনার ধারাবাহিক অভিযোগের মধ্যে ১৩ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে।
সেখানে উদীয়মান অ্যাথলেট ও ছাত্রনেতা হিসেবে নজর কাড়েন ট্রাম্প। ১৯৬৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভর্তি হন ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছর পর ট্রান্সফার হন পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির হোয়ারটন স্কুল অব ফাইন্যান্সে। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকেই অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন।
কলেজে থাকার সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাবার প্রতিষ্ঠানে সময় দিতেন; এলিজাবেথ ট্রাম্প অ্যান্ড সন্স কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে ট্রাম্প তার বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ধার করে নিজেই রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হওয়ার পথে গেলে বাবার ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ডনাল্ডের হাতে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে ফ্রেড ৪৩ বছর বয়সেই মারা যান ।
পরে বাবার পাশাপাশি ব্যবসা করতে গিয়ে নিজের ব্যাবসার বিস্তৃতি বাড়িয়ে তোলেন ট্রাম্প। গ্র্যাজুয়েশনের পর ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর ব্যাপারে বাবাকে রাজি করান তিনি। ১৯৭১ সালে ট্রাম্প কোম্পানির নাম বদলে হয় ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’। ১৯৯৯ সালে ট্রাম্পের বাবা মারা যান।
পারিবারিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়ে ব্রুকলিন ও কুইন্স থেকে প্রকল্প সরিয়ে ম্যানহটনে বড় বড় ভবন নির্মাণে নজর দেন ট্রাম্প। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ম্যানহটনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আঁচ করে সেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন ট্রাম্প। চমৎকার নির্মাণশৈলী ও জনগণের আস্থার কারণে সেই কাজগুলিই পরে তাকে বিপুল মুনাফা এনে দেয়।
ব্যবসা করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রথম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। ওই বছর অঙ্গরাজ্য সরকার ট্রাম্প, তার বাবা ও তাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ আনে। অভিযোগে বলা হয়, ট্রাম্পের কোম্পানি ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে জাতিগত বৈষম্য করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের’ স্পষ্ট লঙ্ঘন। ট্রাম্প অবশ্য বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৭৫ সালে ট্রাম্পের কোম্পানির সঙ্গে রফায় আসে অঙ্গরাজ্য সরকার। ট্রাম্প তার কর্মচারীদের ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং তাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ফেয়ার হাউজিং প্র্যাকটিস নিয়ে প্রচার চালানোর শর্ত মেনে নেন। ১৯৮৭ সালে ট্রাম্পের আত্মজীবনী ‘আর্ট অব দ্য ডিল’-এ ওই ঘটনার কথা বলেছেন ট্রাম্প।
ওই মামলা চলার সময়ই ট্রাম্প গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল নির্মাণে হাত দেন। ম্যানহটনের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে পেন সেন্ট্রাল কোম্পানির কমোডোর হোটেল তখন লোকসানে চলছিল। ১৯৭৫ সালে ট্রাম্প হায়াত হোটেল কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। হায়াত চেইনের তখনও কোনো বড় হোটেল ছিল না। ট্রাম্প সেখানে নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন এক কাচের দালান।
১৯৮০ সালে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল খুলে দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকসানি একটি কোম্পানিকে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেওয়ায় ট্রাম্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এর আগে ১৯৭৯ সালে ট্রাম্প ম্যানহটনের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের বিখ্যাত জুয়েলারির দোকান টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির অফিস সংলগ্ন এলাকায় জমি ইজারা নিয়ে ২০ কোটি ডলারের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন।
কমপ্লেক্সটি ১৯৮২ সালে উন্মুক্ত হয়, পরে যার নাম হয় ট্রাম্প টাওয়ার। ৫৮ তলা এই ভবনে রয়েছে ৮০ ফুট দীর্ঘ একটি কৃত্রিম ঝর্না। বিলাসবহুল এ ভবন ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদেরও আগ্রহী করে তোলে।
১৯৭৭ সালে নিউ জার্সিতে জুয়ার ব্যবসা আইনি বৈধতা পেলে সেখানে টাকা ঢালেন ট্রাম্প। ১৯৮০ সালে তিনি আটলান্টিক সিটিতে জমি কেনেন। হলিডে ইন কর্পোরেশনের অংশীদারিত্বে ১৯৮৪ সালে সেখানে নির্মাণ করেন ২৫ কোটি ডলারের ট্রাম্প প্লাজা। কিছুদিন পর হলিডে ইনের শেয়ার কিনে নেন এবং ওই প্লাজায় নির্মাণ করেন হোটেল ও ক্যাসিনো।
আটলান্টায় হিলটন হোটেলের ক্যাসিনো হোটেলটিও ট্রাম্প কিনে নেন; ৩২ কোটি ডলার খরচ করে গড়ে তোলেন ট্রাম্প ক্যাসল। অল্প সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের হাতে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হোটেল তাজমহল। ১৯৯০ সালে সেটি ট্রাম্প তাজমহল হোটেল নামে যাত্রা শুরু করে।
আটলান্টিক সিটিতে বড় বড় সব নির্মাণ কাজের সময় ট্রাম্প নিউ ইয়র্কেও বারবাইজন প্লাজা হোটেল ও সেন্ট্রাল পার্কে জমি কিনে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাতে ওই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে আশঙ্কা করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো জোট বেঁধে আদালতে যায়। আদালত স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষেই রায় দেয়। পরে ট্রাম্প বারবাইজন প্লাজা হোটেল সংস্কার করেন এবং নাম দেন ট্রাম্প পার্ক।
১৯৮৫ সালে ম্যানহটনের পশ্চিম পাশে ৭৬ একর জমি কিনে সেখানে টেলিভিশন সিটি নামে একটি কমপ্লেক্স বানানোর ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ডজনের উপর সুউচ্চ ভবন, একটি মল ও নদীমুখী পার্ক নির্মাণের এ পরিকল্পনা প্রযোজনা সংস্থা ও টেলিভিশন কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুললেও এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।
১৯৮৮ সালে ট্রাম্প ৪০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে প্লাজা হোটেলটি কিনে নেন এবং আরও পাঁচ কোটি ডলার খরচ করে তা ঝকঝকে করে তোলেন। দক্ষিণাঞ্চলে সাম্রাজ্য গড়ার সময় ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচেও একটি বিলাসবহুল প্রকল্পের কাজ শেষ করেন।
১৯৮৯ সালে তিনি ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ইস্টার্ন এয়ারলাইনস শাটলের একটি শাখা কিনে নেন, পরে যার নাম হয় ট্রাম্প শাটল। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ট্রাম্প ১৯৯২ সালে ওই কোম্পানি বিক্রি করে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মুম্বাই, ইস্তাম্বুল ও ফিলিপিন্সেও ট্রাম্প টাওয়ারের শাখা আছে।
বিভিন্ন হোটেল ও ক্যাসিনো চারবার দেউলিয়ার খাতায় তার নাম তুললেও বৃহস্পতি ট্রাম্পকে ছেড়ে যায়নি। ১৯৯০ এর জানুয়ারিতে ট্রাম্প লস অ্যাঞ্জেলেসে একশ কোটি ডলারের একটি প্রকল্পের ঘোষণা দেন, যেখানে ১২৫ তলা একটি সুউচ্চ অফিস ভবন থাকবে।
২০০০ সালে সুউচ্চ একটি ভবন নির্মাণে আদালতের বাধা অতিক্রম করে আবারও শিরোনামে আসেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। অন্য নির্মাতারা অভিযোগ করে বলেছিলেন- ৮৫৬ ফুট উঁচু ওই ভবন শহরের নির্মাণবিধি লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবির মুখে নগর কর্তৃপক্ষও নির্মাণবিধি সংশোধন করে এ ধরনের উঁচু ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু আদালতের রায় ছিল ট্রাম্পের পক্ষে, তার সেই ভবন নির্মাণ আটকানো যায়নি।
বিনোদোন জগতে পদচারণা
এক সময় বিনোদন জগতেও সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান ডনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশক তার কোম্পানির ঝুলিতে জমা পড়ে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ ও মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কৃতিত্ব।
২০০৪ সালে এনবিসি টেলিভিশনে ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’ নামে একটি রিয়েলিটি শো শুরু করেন ট্রাম্প, যেখানে প্রতিযোগীদের পুরস্কার ছিল ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরি। টানা ১৪টি সিজন ওই শো উপস্থাপনা করেন ট্রাম্প। সেই প্রতিযোগিতা তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এনে দিয়েছিল।
ওই সময়ই ট্রাম্পের কণ্ঠে ‘ইউ আর ফায়ারড’ সংলাপটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্য অ্যাপ্রেন্টিস বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছিল বলেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার শিবিরের দাবি।
অ্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ট্রাম্প বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। তার রয়েছে একটি চেইন শপের ব্যবসা। বিশ্বজুড়ে টাই থেকে শুরু করে বোতলজাত পানি বিক্রি করছে ওই কোম্পানি।
২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের পর তার ব্যবসার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদের ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের’ প্রসঙ্গও সামনে চলে এসেছিল; মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প আর জামাতা জ্যারেড কুশনারকে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা বানানোয় তার বিরুদ্ধে ‘স্বজনপ্রীতির’ অভিযোগও ওঠে। নানান মারপ্যাঁচে সেসব দিক ঠিকই সামলে উঠেছিলেন তিনি।
বাবা ও স্বামী
ট্রাম্প এ পর্যন্ত বিয়ে করেছেন তিনবার। তার ভাষায়, প্রথম স্ত্রী চেক অ্যাথলেট ও মডেল ইভানা জেলনিকোভা উইঙ্কেল মেয়ারই ছিলেন তার কাছে সবচেয়ে ‘প্রিয়’। নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন মডেল ইভানা ১৯৭২ সালের চেক অলিম্পিক দলের স্কি টিমে ছিলেন।
ইভানা ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন; গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল ও প্লাজা হোটেল সংস্কারেও তার ভূমিকা ছিল। এ দম্পতির তিন সন্তান- ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক ট্রাম্প। ১৯৯০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদ নিয়ে মীমাংসার সময় বিভিন্ন ট্যাবলয়েড এ দম্পতিকে নিয়ে নানা মুখরোচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এর মধ্যে ছিল ইভানাকে যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা ও অবমাননার অভিযোগ। পরে ইভানা নিজেই সেসব প্রতিবেদনকে ‘সত্য নয়’ বলেছিলেন।
১৯৯৩ সালে মডেল মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। ছয় বছর পর বিচ্ছেদের আগে তাদের ঘরে আসে কন্যাসন্তান টিফানি ট্রাম্প।
মেলানিয়া নউসের সঙ্গে ট্রাম্পের বিয়ে হয় ২০০৫ সালে। সেই বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন ২০১৬-র নির্বাচনের ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ও তার স্বামী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।
বয়সে ২০ বছরের ছোট মেলানিয়ার ঘরে একটি ছেলে আছে ট্রাম্পের, তার নাম ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প। ডনাল্ড ট্রাম্পের নাতি-নাতনির সংখ্যা ৭।
হাতির পিঠে হোয়াইট হাউসে
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা প্রথম বলেন ১৯৮৭ সালে, তখন গণমাধ্যম এটাকে তার প্রচারের চমক ছাড়া আন্তরিক কোনো উদ্যোগ বলে মনে করেনি। ১৯৯৯ সালে নিজের ভোটার নিবন্ধন রিপাবলিকান থেকে রিফর্ম পার্টিতে সরিয়ে নেন ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্সিয়াল অনুসন্ধান বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করেন।
কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারিতে রিফর্ম পার্টির হয়ে বাজেভাবে হারার পর তিনি ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ওই বছর ‘দ্য আমেরিকা উই ডিজার্ভ’ নামে নিজের একটি বই প্রকাশ করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি নিজের সামাজিকভাবে উদারনৈতিক কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। পরে আবার রিপাবলিকান পার্টিতে ফিরে আসেন।
২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘বার্থার’ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হন ট্রাম্প। ওই আন্দোলনে ওবামার জন্মস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তোলা হয়। ত্যক্ত বিরক্ত ওবামা এক পর্যায়ে তার জন্মের সনদ প্রকাশ করেন, সেখানে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তার জন্ম।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমে চাপের মুখে আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান ট্রাম্প। ওবামার জন্ম যে যুক্তরাষ্ট্রেই, এক বিবৃতিতে তিনি তা মেনে নেন। উল্টো বার্থার আন্দোলন শুরুর দায় দেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে। ২০০৮ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন যুদ্ধের সময় হিলারি শিবিরই নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ওবামার বিরুদ্ধে প্রথম ওই অভিযোগ তুলেছিল, অন্তত ট্রাম্পের তেমনটাই দাবি।
২০১৫ সালের জুনে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হতে চেয়ে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হন। রিপাবলিকান পার্টিতে ফের যোগ দেওয়ার পর থেকে ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ব্যানারে ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং মুসলিম অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কথা বলে অনেক রথী মহারথীর কাছে সমালোচিত হলেও মাঠে তার জনসমর্থন ছিল অবাক করার মত।
নারীদের প্রতি ট্রাম্পের ধারণা ‘বাজে’- ধারাবাহিকভাবে এমন দাবি করে আসছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট শিবির। নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে ফাঁস হওয়া একটি টেপ সেই দাবিকে সুসংহত করে। ওই টেপে ট্রাম্প নারীদের বিষয়ে আপত্তিকর কথা বলেছিলেন।
ওই ভিডিওকে ট্রাম্প ‘লকার রুমের’ কথোপকথন বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের গা বাঁচাতে ঢাল বানানোর চেষ্টা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারির স্বামী বিলের কেলেঙ্কারিকে। ট্রাম্প বলেন, “আমি তো কেবল বলেছি, বিল ক্লিনটন তো করেই দেখিয়েছে।”
নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কের মধ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন নারী। সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে ট্রাম্প বলেন, তাকে ফাঁসাতে হিলারি শিবির ও প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যম ‘নাটক সাজিয়েছে’।
প্রচারের বিভিন্ন সময় নারীদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যসহ অনেক ইস্যুতে প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকান নেতা ও সিনেটর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় সাময়িক ভাটা পড়ে।
তবে সেসব টপকে নির্বাচনের আগে আগে ইমেইল কেলেঙ্কারিতে পর্যদুস্ত হিলারির সঙ্গে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনেন এই ধনকুবের। বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ৮ নভেম্বর ভোটে জিতে তিনি হয়ে যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার রানিংমেট হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন মাইক পেন্স।
হিলারি ২৮ লাখ পপুলার ভোটে এগিয়ে থাকলেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্পের কাছে হেরে যান, ট্রাম্প পান ৩০৪ ভোট আর হিলারি ২২৭।
বিপদের সময় প্রভাবশালী যে রিপাবলিকান সিনেটররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, ‘কী করে জিততে হয়,’ আর তা তিনি করেও দেখান।
এরপর ২০২০ সালে বাইডেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় হারলেও গত চার বছর ধরে অনুসারীদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন ট্রাম্প।
পর্যবক্ষেকদের ধারণা, ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় আসেন তবে তিনি গাজা, লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান বহুমুখী যুদ্ধে ইসরায়েলকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবেন। আবার ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপকে এড়িয়ে কিইভকে পাত্তা না দিয়ে মস্কোর সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা চালাতে পারেন।
অবশ্য বিশ্লেষকের এও ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যিনিই নির্বাচতি হন না কেন, বিশ্বের সামগ্রিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে।