কয়েকটি দল ভোটের জন্য সরকারকে চাপ দিলেও আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিপরীত অবস্থানে।
Published : 12 Jan 2025, 01:43 AM
প্রশাসনে অস্থিরতা, ‘বঞ্চিত’ পেশাজীবী-শ্রমজীবীদের বিক্ষোভের মধ্যে সংস্কারে উদ্যোগী ও ঐক্যের সন্ধানে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ মাস পূর্ণ করেছে, সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ দিন দিন বাড়ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনে দেরি হলে এই সরকার বিতর্কিত হবে। আর দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি মনে করে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে দেড় দশক কর্তৃত্ব করা বিগত সরকারের ‘দোসরদের ষড়যন্ত্র’। নির্বাচনে যত দেরি হবে, এমন সমস্যা তত বাড়বে।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের উদ্যোগে নাগরিকদের নিয়ে গড়া জাতীয় নাগরিক পরিষদ সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন চায়।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কবে হবে তা জানতে আগ্রহী হয়েছে উঠেছে সাধারণ মানুষও, যারা বাজার দরের উর্ধ্বগতি আর বেকারত্বের চক্করে পড়ে নাজেহাল।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী সোবহান মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই, কত দিন লাগবো সংস্কার করতে? জিনিসপত্রের দাম হু হু কইরা বাড়ছে, দাম কমাতে পারছেন না, নির্বাচন দেবেন না- এটা কেমন কথা।
“কী কী সংস্কার করলে নির্বাচন ভালা হইব, হেইডা করেন? এভাবে মাসের পর মাস যাইব, বছর যাইব… এইডা হয় না।”
বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলের বর্জনের মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলন দানা বাঁধে সে বছর জুলাই মাসে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনে সহিংসতার জেরে সে মাসের মাঝামাঝি সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
আন্দোলনের প্রবল ধাক্কায় ৫ অগাস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশ তিনদিন সরকারবিহীন থাকার নজিরবিহীন ঘটনার পর ৮ অগাস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তার আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় দ্বাদশ সংসদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের মত ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে অক্টোবর-নভেম্বরে মোট ১১টি কমিশন গঠন করে।
সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর এর পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন বা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও নির্বাচন পাশাপাশি চলার কথা বললেও সংস্কারের জন্য নির্বাচন যাতে ‘বিলম্বিত’ না হয়, সে দিকে রাজনৈতিক দলগুলো নজর দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়েছেন। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথাও তিনি বলেছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের শেষের দিকে, আর সংস্কার শেষ করতে দিলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সরকারের তরফে।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার মধ্যে গত ৮ জানুয়ারি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার প্রস্তুতির কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। পরের দিন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে অগ্রসর হবে সরকার। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে না পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে– তা নিয়ে কিছু বলেননি।
প্রথমধাপে করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চলতি মাসে দেওয়ার কথা রয়েছে। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। আর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে।
সোমবার মুন্সীগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ, গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, “প্রধান উপদেষ্টা এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের একটি টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী জানুয়ারি মাসের মধ্যে সংস্কার কমিটির রিপোর্টও জমা হবে।
“প্রতিবেদনগুলো পাওয়ার পরেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।”
সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন’ কমিশনের পাশাপাশি ভোটের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ধারণা দিয়েছেন ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে।
তিনি বলেছেন, “মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
সর্বশেষ ৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি রূপা হকের সাক্ষাতের সময়ও তিনি নির্বাচনের সম্ভাব্য সেই দুটি সময়সীমার কথা বলেছেন।
তার আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা আইনে সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়।
বিএনপি ও জামায়াত যা বলছে
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রথম থেকেই সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার কথা বলে আসছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দিক থেকে এ বছরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়ছে।
২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, তারা সংস্কারের বিপক্ষে নয়। তবে সব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখছে দলটি। বিএনপির নিজেদেরও ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে।
দলটি বলছে, ‘অতিপ্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে, সেটা যত দ্রুত করা যায়। বাকি সংস্কার বাস্তবায়ন জনগণের নির্বাচিত সংসদের সিদ্ধান্তে হবে।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতারা ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিয়ে আসার পাশাপাশি দলটি করণীয় ঠিক করতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে। বৈঠক শেষ করার পর সিদ্ধান্ত জানানোর কথা রয়েছে।
নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে ঐক্য খোঁজার চেষ্টায় ২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর দুদিনের জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ (এফবিএস) নামের একটি সংগঠন।
সে সংলাপের প্রথম দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “সংস্কার নিয়ে যত বেশি সময় যাবে আমার কাছে মনে হয়, আমাদের কাছে মনে হয় যে, সমস্যাগুলো তত বাড়বে। আসল জায়গা তো… প্রবলেম তো অন্য জায়গায়। আপনি এটা ইমপ্লিমেন্ট করবেন কাদের দিয়ে?”
৯ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “একটা কাঠামো তৈরি করেন; সংস্কার অবশ্যই লাগবে। কিন্তু সেই সংস্কারের পেছনে যে শক্তিটা লাগবে সেটা হচ্ছে যে নির্বাচিত সংসদ; নির্বাচিত সরকার। এটা ছাড়া সংস্কারকে কখনো লেজিটেমেসি (বৈধতা) আমরা দিতে পারব না। এটা ফ্যাসিস্টরা পারবে।”
তিনি বিভাজনের রাজনীতির বিষয়ে সতর্ক করেন। বলেন, “হাসিনা পালানোর পর থেকে আমরা কেন জানি নিজেদের মধ্যে পুরো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারছি না, ঐক্যের জায়গায় থাকতে পারছি না। দেখুন না, কি একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য।”
তার আগে ৯ ডিসেম্বর ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিএনপির পক্ষ থেকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে।
ঢাকার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, “সরকারের আরও সংস্কার… প্রশাসনিক সংস্কার, জুডিশিয়াল সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংস্কার আছে, এগুলো সব সম্পন্ন করে নির্বাচন উপহার দিতে আমাদের মনে হয় না খুব বেশি হলে ৩/৪ মাসের বেশি সময় লাগবে।”
প্রথম দিকে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া জামায়াতও এখন নির্বাচন নিয়ে সরব। ‘অতিজরুরি’ সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরকারকে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান।
৩ জানুয়ারি নাটোরে এক কর্মী সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, “আপনারা দেরি না করে অতিজরুরি সংস্কার কাজ শেষ করে একটা নির্বাচন দিয়ে আপনাদের যার যার জায়গায় ফিরে যান।
“এই নির্বাচনে জনগণ যাকে ভালোবাসবে, যার উপরে আস্থা রাখতে পারবে- তাদেরকে দেশের দায়িত্ব দিলে তারা দেশের মানুষকে সম্মান করবে।”
‘মানুষ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়’, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদের এই বক্তব্যের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে বক্তব্য আসে। নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয় আরেক বিতর্ক।
বিএনপি নেতারা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানবেন না বলেছেন। আর তাদের বিপরীতে জামায়াত ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির অবস্থানের খবর হয়েছে।
সিপিবি, এনডিএম ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি যা বলছে
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, আমরা শিগগিরই নির্বাচন চাই। যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে, তত শিগগির চাই। সেটা ছয়মাস হোক আর নয় মাস হোক, আর এক বছর হোক। আর সেটা নিশ্চয়ই এ বছরের মধ্যে।”
তিনি বলেন, “পাঁচ মাস ইতোমধ্যে হয়ে গেছে আরও এক বছরের বেশি লাগবে, এটার তো কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। অবশ্যই এই বছরের মধ্যে নির্বাচনটা হতে হবে।”
এ বছরের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা চায় কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি)।
৩ জানুয়ারি ঢাকায় দলটির সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “সংস্কারের কথা শব্দ চয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রাজনৈতিক দল ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয় সুনির্দিষ্ট করুন।
“অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে যেন না পারে সেজন্য দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।”
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের যে প্রস্তুতি, আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের আগামী মে-জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব।
“ইতোমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে, ২০ তারিখ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা চেক করবে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়াটা করে ফেলতে পারে। এ বছরের অক্টোবর নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করায় আমি কোন সমস্যা দেখছি না।
“আর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে রাজনৈতিক দল গুলোর সঙ্গে বসে কি কি সংস্কার করা দরকার তা শেষ করে একটা মতৈক্যের জায়গায় আসতে পারব।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করে এ বছরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব এবং এটা আমরা চাই। যদি মনে হয় সরকার অপ্রয়োজনীয় ভাবে কালক্ষেপণ করছে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে বিতর্ক দেখা দিবে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন নিয়ে আলোচনায় আসা ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) ভিপি নির্বাচিত হওয়া নূরুল হক নুরের দল গণঅধিকার পরিষদ চায় রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচন হোক।
‘গণপরিষদ’ চায় শিক্ষার্থী ও নাগরিক সংগঠকরা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আছে আন্দোলনের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিভিন্ন জেলায় তাদের নেতারা সভা-সমাবেশ করছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটি চাইছে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার, তারপর নির্বাচন।
সংগঠন দুটি বলছে, নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে তাও আগে চূড়ান্ত করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্থা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন বলেন, “নির্বাচন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন গণপরিষদ নির্বাচন।”
সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরি সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
“নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা আমাদের বক্তব্য খোলাসা করে বলেছি। জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে আসলে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, সে আকাঙ্ক্ষা ফুলফিল হবে না।
“দেশের প্রত্যেকটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিকল করা হয়েছে, তাই রিফমর্সের মাধ্যমে একটি নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব।”
সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দল, পক্ষ ও মতের মানুষকে একত্রে পুনর্গঠনের কাজগুলো করা উচিত বলেছেন সামান্থা শারমিন।
“সেই সঙ্গে নির্বাচনের কথায় আরেকটু আসি, তাহল- অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেহেতু বিকল হয়েছে, একটি অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে; কিন্তু সেটার কোনো দালিলিক স্বীকৃতি নেই, সেই স্বীকৃতির ইনক্লুশন এবং সাংবিধানিক সংকট বলে যে জায়গাগুলো আমাদের দেখানো হয়েছে, এ যে সংবিধান এটাকে পরিবর্তন করার জন্য আমাদেরকে গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।”
সামান্থা বলেন, “আমরা অবশ্যই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচন একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপায়। তবে গণপরিষদ নির্বাচন কী ও কেন, কীভাবে হতে পারে, প্রক্রিয়া কী হবে এবং আনুপাতিকে যাব নাকি ট্র্যাডিশনাল ফরমেটে যাব- এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা দল, মত ও পক্ষগুলোর সাথে করতে পারি।
“কিন্তু, গণপরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যথা হবে না।”
গণপরিষদ নির্বাচন কেন প্রয়োজন তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “জয়ী ব্যক্তিদের একমাত্র কাজ হবে সংবিধান পরিবর্তন করা। সংবিধান পরিবর্তনের সাথে আমরা প্রস্তাব করছি- এটা (গণপরিষদ) আইন সভারও কাজ করতে পারে। যাতে করে সংস্কার কার্যক্রম, সংবিধান পুনর্লিখন, সেই সাথে আইন সভার কাজ করা যাবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সিস্টেমটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে নির্বাচন দিয়ে তো তেমন একটা লাভ নেই। এটার মাধ্যমে নতুন একটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠা খুব সহজ।
“তাই আমরা আশা করব, বর্তমান যে নির্বাচনী কাঠামো এবং একই সাথে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক কাঠামো, তাতে একটা পরিবর্তন আসা প্রয়োজন।”
বাদ পড়া ভোটারদের যুক্ত করতে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ
এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার যে ইঙ্গিত প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন সে অনুযায়ী ভোট করতে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। যদি ভোট এগিয়ে আসে তাহলে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজও গুছিয়ে নেবে বলেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। ২ জানুয়ারি নতুন করে যুক্ত হয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন নতুন ভোটার।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সেদিন খসড়া ভোটার তালিকার তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। নতুন ভোটারদের নিয়ে দেশে এখন ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২।
পাশাপাশি বাদ পড়া ভোটার ও ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হবে তাদের নিবন্ধন করতে তথ্য সংগ্রহ শুরু হচ্ছে ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। জুনের মধ্যে সবার তথ্য নেওয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আগামী জানুয়ারির আগে ভোট হলে সে বিষয়েও ভোটারযোগ্যদের তালিকাভুক্ত করতে আইনি কোনো জটিলতা রাখবে না বলেছে নির্বাচন কমিশন।
সেদিন এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. সানাউল্লাহ জানান, যাচাই বাছাই কার্যক্রম ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদ কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় মূলত দুটো জিনিস রয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০০৭ এর আগে যাদের জন্ম বা তার আগে যাদের জন্ম বা ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হয়েছে, কিন্তু ভোটার তালিকায় সন্নিবেশিত হননি, তাদের তালিকাভুক্ত করা।
তিনি বলেন, “এ নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা নেই। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে তাদের তালিকাভুক্ত করব। এ বছর যারা ভোটার হবে, যারা ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর হবে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।”
এই নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, যদি দেখা যায়, ভোটের আগে উল্লেখযোগ্য ভোটার বয়োপ্রাপ্ত হয়ে গেছেন তাহলে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করে তাদের ভোটার তালিকায় সন্নিবেশ করা যায় কি না তা যাচাই করে দেখা হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত হননি তারা।
বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা তুলে ধরার পরদিন এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।
সেদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, “জাতীয় নির্বাচনের জন্য আমরা প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছি। জাতীয় নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তুতির দরকার, তার সবই আমাদের রয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের যে সময় ইঙ্গিত করেছেন, সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
সংসদ ছাড়া সংস্কার বৈধতা পাবে না: ফখরুল
২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে: জামায়াতের নায়েবে আমির
১৫ জানুয়ারির মধ্যে ভোটের তারিখ ঘোষণা চায় সিপিবি
'তিন-চার মাসের মধ্যে' নির্বাচন চাইল বিএনপি
আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন: ভিপি নূর
সংস্কার না করে নির্বাচন নয়: সিলেটে সারজিস আলম
বিভ্রান্ত না হয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিন: তারেক রহমান
নির্বাচন কবে? জবাব এল, 'আগে সংস্কার'
নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, ব্রিটিশ এমপিকে ইউনূস
সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে: ইউনূস