আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এক দশক আগে প্রতিবেদন জমা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সংগঠনের শাস্তি কী হবে, সেটি নির্দিষ্ট না হওয়ায় বিচার শুরু হচ্ছে না। এক দশকের আইন সংশোধন হয়নি।
Published : 01 Aug 2024, 11:22 PM
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রসঙ্গটি আটকে আছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। সেটিও আটকে আছে একটি মাত্র কারণে আর তা হল সংগঠনের সাজা কী হবে, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা নেই কিছু আইনে।
অথচ জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণার পর ‘গণজাগরণ’ নামে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭২ এ যে সংশোধনী আনা হয়, সেখানে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগও রাখা হয়। কিন্তু সংগঠনের সাজার কী, সেটি আর উল্লেখ করা হয়নি।
ওই বছরই মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক মামলায় জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ আখ্যা দেওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন ১০ বছর ধরে পড়ে আছে।
সরকারের তরফে বারবার আইন সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, বছর দুয়ের আগে আইনমন্ত্রী ‘কিছুদিনের মধ্যেই সংশোধনের’ আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু ২০ মাসেও এই কিছুদিন আর আসেনি।
আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ’এই আইনের সংশোধনের কোনো প্রস্তাবের খসড়া এখনো আমরা পাইনি।’
এর মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে নজিরবিহীন সহিংসতা ও সরকারি হিসাবে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ ঘোষণা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।এই ঘটনায় জামায়াতের বিচারের প্রসঙ্গটি আবার সামনে এসেছে।
ধর্মভিত্তিক দল তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব আইনের সংশোধনী পাস করা উচিত। আমরা আগেও বলেছি, সংশোধনী দ্রুত পাস করার জন্য, প্রয়োজনে আবারো তাগিদ দেব আইনমন্ত্রীকে।”
একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর বাহিনীর পাশাপাশি শান্তি কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জামায়াত ও তার সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ।
এই আলবদর বাহিনীর হাতেই ঘটে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। জামায়াতের যে নেতারা ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তাদের মধ্যে কাদের মোল্লা ছাড়া সবাই ছিলেন এই বাহিনীর সদস্য।
সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।
মুক্তিযুদ্ধে এসব অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লা ছাড়াও ফাঁসিতে ঝুলেছেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। আরেক নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির সাজার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি এখনও।
জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে দেওয়া হয় ৯০ বছরের সাজা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড। কারাগারেই মারা যান তারা বন্দি অবস্থায়।
রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াত নেতা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ মারা যান বিচার চলাকালে।
এসব একাধিক মামলার রায়ে ৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন বিচারকরা।
২০১৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশে জামায়াতের ‘গুরু’ গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে বলা হয়, “গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে।”
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের।
জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে।
“স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়।”
রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলে, “সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন।”
তদন্তে কী পাওয়া গেছে
এরপর একাত্তর সালে দল হিসেবে জামায়াতের অপরাধ তদন্ত করে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
এই প্রতিবেদনে গণহত্যাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াত ও তার সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া আগে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠনগুলো যে সারা বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ তারা পেয়েছেন।
জামায়াতের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন এবং একাত্তরের আল বদর, আল শামস সদস্যদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও আর্জি জানানো হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
জামায়াত ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ সাত ধরনের অভিযোগ আনা হয় ওই প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী, তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৪ এর ১ ও ৪ এর ২ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে।
যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাজার পর প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ২০১৩ সালের ১৮ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের এই তদন্ত শুরু করেন।
৩৭৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মোট ৭০ জনকে সাক্ষী করা হয়। তাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাও ছিলেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ৭ খণ্ডে ২ হাজার ২ হাজার ৩০৩ পৃষ্ঠার জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণপত্র, ১০ খণ্ডে ৩ হাজার ৭৬১ পৃষ্ঠার অন্যান্য নথি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আগের দেয়া রায় ও জামায়াতের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণও দাখিল করে তদন্ত সংস্থা।
এক দশক পেরিয়ে গেলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখায় হতাশ তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের কাজ শেষ করে আমরা জমা দিয়েছিলাম। আমাদের হাতে কিছু নেই। চিফ প্রসিকিউটর বলতে পারবে ওই প্রতিবেদন বিষয়ে অগ্রগতি। এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে চাই না।”
আইন সংশোধনে আর কত দেরি
তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দেওয়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন নিয়ে একই ধরনের কথা বলে আসছে।
২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কিছু আইনগত ভাষার বিষয়ে আবার পাঠায়। এটি এখন আমাদের কাছে আছে।
“প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে আবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে, যাতে এটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয় এবং পাস হয়।”
২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের আবার কিছুদিনের মধ্যেই আইন সংশোধনী চূড়ান্ত করার কথা বলেন।
সেদিন তিনি বলেন, “এই জামায়াতের বিচার করার জন্য আইনের পরিবর্তন দরকার হবে, সেটা আমি আগেই বলেছি। সেই আইনের যে পরিবর্তন-সংশোধন, সেটা মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হয়েছে। আমরা কিছু দিনের মধ্যেই এই আইনটা পাস করব, তারপর বিচার কার্যক্রম শুরু করব।”
২০২৩ সালের ৬ মে ঢাকায় বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সরকারি জজদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন শেষে একই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”
আইনমন্ত্রী কিছুকাল পরপরই একই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার পরও কার্যকর পদক্ষেপ না দেখে হতাশ হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ট্রাইব্যুনালের কাজ প্রসিকিউশন থেকেই করা হচ্ছিল, অনেকদূরই এগিয়ে গিয়েছিলাম। ১০ দিন বাকি ছিল ফর্মাল জাজ সাবমিট করার, হঠাৎ করে আমার কাছ থেকে সব ফাইল চেয়ে নেওয়া হল, এবং আইনমন্ত্রী বললেন, ‘আইন পরিবর্তন করেই এই বিচার করব, বারবার করব না’, এর উত্তর আসলে উনিই দিতে পারবেন।”
“আইনমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন, কতটুকু সময় লাগতে পারে, এবং কেন বা কেন এত সময় নিচ্ছেন বা দেওয়া হচ্ছে। ১০ বছর আগে যে বিচার করার কথা ছিল, সেটা করলাম না”, আক্ষেপ ঝরে পড়ে তুরিনের কণ্ঠে।