সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে জলাবদ্ধতা নিরসনে।
Published : 04 Jun 2024, 10:53 PM
বন্যা নিয়ন্ত্রণে দেড় দশকে হাজার কোটি টাকার উপরে খরচ করলেও কয়েক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট নগরী। বিশেষজ্ঞরা এজন্য ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নকে’ দায়ী করলেও সিটি করপোরেশন তা মানতে নারাজ।
ভারতের মেঘালয়ের ঢালে অবস্থিত সিলেট জেলায় বর্ষাকালে বন্যার ঝুঁকি থাকেই। এর মধ্যে টানা বৃষ্টিতেও অনেক সময় নগরীর সব রাস্তাঘাট তলিয়ে জলবদ্ধতা তৈরি হয়; যাতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
রোববার টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর ১০০টি পাড়া-মহল্লার বাসা-বাড়ি জলমগ্ন হয়। এ সময় ২৪ ঘণ্টায় ২২৬.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের তথ্য জানিয়েছিল আবহাওয়া কার্যালয়। এর আগে ২০২৩ সালের ১৪ জুন মাত্র ছয় ঘণ্টায় ১৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিতেও তলিয়ে গিয়েছিল নগরীর অধিকাংশ এলাকা।
এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেট অঞ্চলে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে বারবার বন্যার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা এজন্য ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই’ দায়ী করছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে জলাবদ্ধতা নিরসনে।
সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতার ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক মো. জহির বিন আলম বলেন, নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এটি কোনো সমাধান নয়।
তিনি বলেন, “বক্স কালভার্ট নির্মাণে আমরা নিষেধ করেছি; স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সামনেই সবাইকে তথ্য দিয়েছি। তারপরও এগুলো কেন করা হচ্ছে তা আমি জানি না। এটা পরিকল্পিত কাজ নয়; অপরিকল্পিত। এটা কার উদ্দেশ্য বা কেন করতেছেন তারা? আগের কোনো প্ল্যান থাকলে পরিবর্তন করবেন উনারা।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “প্রথমত সিলেট শহরটি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। আর বর্তমানে সেভাবে চলছে। তাই সরকারের হাজার-হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশন একটি বড় প্রতিষ্ঠান, তাই এই প্রতিষ্ঠানের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ দরকার; যিনি সরেজমিনে নগরীর জলাবদ্ধতাসহ যাততীয় কাজের পরিকল্পনা করবেন। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ আছেন কি-না সিটিতে।
“আর বর্তমানে নগর বড় হয়েছে, তাই নতুন করে পরিকল্পনা করা দরকার। তা না হলে পরিকল্পিত উন্নয়ন কিভাবে হবে? অন্তত পাঁচ বছর পর পর উন্নয়নের জন্য নতুন করে পরিকল্পনা করা দরকার।”
সিলেট নগরীতে ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’ হয়েছে দাবি করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “সম্প্রতি নগরীর দরগা গেইট এলাকায় রাস্তার দুইপাশে বক্স ড্রেন থাকার পরও রাস্তার মাঝখান দিয়ে পানি নিষ্কাশনে বড় বক্স কালভার্ট নির্মাণ করেছে। যদি পরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ হত, তাহলে দুইপাশে ড্রেন রেখে মাঝখানে বক্স কালভার্ট নির্মাণ হওয়ার কথা নয়। এতেই বোঝা গেছে, কতটুকু অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড চলছে সিলেট নগরীতে।”
তিনি আরও বলেন, “এ রকম উন্নয়ন কাজ নিশ্চয়ই প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার জন্য হয়। না হলে এত টাকা খরচের পরও কেন নগরী ডুববে? অতীতেও সিলেটে প্রচুর বৃষ্টি হতো, তবে এমনভাবে নগরী ডুবেনি।”
বাসদ সিলেট জেলার সদস্যসচিব ও নগরীর সুবিদবাজারের বাসিন্দা প্রণব জ্যোতি পাল বলেন, “বৃষ্টি হলেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বারবার দাবি তোলার পরও সুরমা নদীর খনন কাজ হয়নি। সংস্কার হয়নি অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাও।”
তবে ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’ এর অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “২০১১ সালের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সিলেট নগরীর উন্নয়ন কাজ চলছে। প্রকৌশল বিভাগ ছাড়াও বুয়েট ও ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা হচ্ছে। এখানে অপরিকল্পিত কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না।”
সিলেট নগরীতে চলছে ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’, প্রাচীন বৃক্ষ নিধন
সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নগরীর পানি নামতে পারছে না জানিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, “হঠাৎ করে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হলে এই সমস্যা হত না। জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ হচ্ছে সেটা আমরা বুঝতে পারতেছি। তবে নগরের ড্রেন-ছড়া পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব সবার; আমাদের সচেতন হতে হবে।
“এ ছাড়া সুরমা নদী খনন ও শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। সে অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন কাজ করছে। আর দেখেন, নগরীর চারপাশে বড় বড় বিল্ডিং ও রাস্তাঘাট পাকা থাকার কারণে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে যেতে পারছে না, সেটাও আমাদের বুঝতে হবে।”
নগরীর উপশহরে বেশি জলাবদ্ধতার বিষয়ে প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, উপশহরের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট আরও পাঁচ ফুট উপরে হলে এ সমস্যা হত না। এটা আগেই করা দরকার ছিল। তবু সিটি করপোরেশন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উপশহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে।
সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আসাম থেকে নেমে আসা সুরমা নদী খননের কাজ চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, “শহরের অংশে প্রচুর পরিমাণ পলিথিন ও মেডিকেলের বর্জ্যের কারণে ঠিক মত ড্রেজার চালানো যাচ্ছে না। দেখা গেছে, আধা ঘণ্টা ড্রেজার চালানোর পর আর চলছে না। পরিষ্কার করে আবার চালাতে হচ্ছে, এজন্য কাজে সময় বেশি যাচ্ছে। তবে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।”
সিলেট পাউবোর তথ্যমতে, ২০২২ সালের বন্যার পর সুরমা নদী খননের দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নগরীর উপশহরের কুশিঘাট থেকে লামাকাজী সেতু পর্যন্ত সুরমা নদীর যেসব স্থানে চর জেগেছে; তা কেটে অপসারণ ও খননের উদ্যোগ নেয় পাউবো।
প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশে এ খননের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি সুরমা নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে আব্দুল মোমেন।
একই প্রতিষ্ঠানের সিলেট জেলার আরেক প্রকৌশলী বলেন, “প্রায় আড়াইশ কিলোমিটারের সুরমা নদীর নগর সংশ্লিষ্ট ১৫ কিলোমিটার খনন করলেই শুধু হবে না। পুরো নদীটি খনন করার প্রয়োজন, তা না হলে সমস্যার সমাধান হবে না।”
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার তথ্যমতে, ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ছড়া খনন, ছড়ার পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, ইউ-টাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নালা-নর্দমা প্রশস্তকরণসহ জলাবদ্ধতা নিরসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
চলতি বছর একই খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরও প্রায় ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। এর বাইরে সিটিতে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৫টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩০০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প সম্প্রতি অনুমোদন হয়। এসব প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ পেলে দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।