চলে গেলেন ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার’ পথিকৃৎ মার্ভিন মিনস্কি

যন্ত্রকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের কাজ সহজ করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কি মারা গেছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2016, 08:48 AM
Updated : 26 Jan 2016, 07:14 PM

যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে স্থানীয় সময় রোববার রাতে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ৮৮ বছর বয়সী এ বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়। 

পত্রিকাটি লিখেছে, ‘জ্ঞানের জন্য বিজ্ঞানীদের যে তৃষ্ণা’, তার সঙ্গে ‘সত্যের জন্য দার্শনিকের অন্বেষার’ মেলবন্ধন ঘটেছিল মিনস্কির মধ্যে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে তার কাজ আজকের পার্সোনাল কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের উদ্ভাবনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। 

মাইক্রোপ্রোসেসর ও সুপার কম্পিউটার উদ্ভাবনেরও বহু আগে অধ্যাপক মিনস্কিসহ গুটিকয় বিজ্ঞানীর ধারণা থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুন এই শাখার গোড়াপত্তন হয়েছিল। বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থির সঙ্গে মিলে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তিনি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা নিকোলাস নেগ্রোপন্টে এক ইমেইলে ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ‘ফ্যাকাল্টি’ মিনস্কির মৃত্যুর খবর তার সহকর্মীদের জানান। সেখানে মিনস্কিকে তিনি অভিহিত করেন ‘ওয়ান অফ দি গ্রেটেস্ট মাইন্ডস ইন সায়েন্স’ হিসেবে। 

“তিনি হাস্যরস আর গভীর চিন্তার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। পৃথিবীকে তিনি দেখতেন ভিন্ন চোখে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, কঠিনের সমাধান সহজেই পাওয়া যায় অনেক সময়, সহজগুলোই হয়ে ওঠে অনেক কঠিন।”

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে ডক্টরেট করা মিনস্কি ১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথে কম্পিউটারের কাজ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই মাসের এক সিম্পোজিয়ামে অংশ নেন।

এরপর তিনি লেখেন ‘পারসেপট্রনস’, ‘দ্য সোসাইটি অব মাইন্ড’ এবং ‘দ্য ইমোশন মেশিন’, যে বইগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যলেঞ্জ বুঝতে আজকের গবেষকদের জন্যও অবশ্য পাঠ্য।

অবশ্য এর আগেই, ১৯৫১ সালে ডিন এডমন্ডসের সঙ্গে মিলে মিনস্কি তৈরি করেন ‘স্টোকাস্টিক নিউরাল অ্যানালগ রিইনফোর্সমেন্ট কম্পিউটার’, যাকে বিশ্বের প্রথম ‘কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক’ বলা হয়ে থাকে।  

পরের দিনগুলোতে যান্ত্রিক বাহু ও হাত, কনফোকাল স্ক্যানিং মাইক্রোস্কোপ ও অন্যান্য রোবোটিক ‘যন্ত্র’ উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মিনস্কি। ই. ফ্রেডকিনের সঙ্গে তার বানানো সিনথেসাইজার ‘মিউজ’ প্রযুক্তির অঙ্গনে নতুন চমক হয়ে আসে।

মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান ড. হেনরি মিনস্কি ও ইহুদিবাদী সমাজকর্মী ফেনি রেইজারের সন্তান মার্ভিন লি মিনস্কি ১৯২৭ সালের ৯ অগাস্ট নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে যোগ দিতে হয় নৌবাহিনীতে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ভর্তি হন প্রিন্সটনে। সেখানেই তার দেখা হয় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র আরেক দিকপাল জন ম্যাকার্থির সঙ্গে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে আলবার্ট আইনস্টাইন ও জন ফন নিউম্যানের সঙ্গেও মিনস্কির যোগাযোগ ঘটে।

গত বছর এক সাক্ষাৎকারে সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মিনস্কি বলেন, “আইনস্টাইনের সঙ্গে কয়েকবার দুপুরে খেয়েছি। কিন্তু জার্মান উচ্চারণের জন্য তার কথা ঠিক বুঝতে পারতাম না।

“তবে নিউম্যানের সঙ্গে অনেকবারই কথা হয়েছে। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমরা কম্পিউটিং থিওরি বা অটোমাটা থিওরি নিয়ে কথা বলতাম।”

সেই সাক্ষাৎকারে মিনস্কি বলেন, যন্ত্রও একদিন চিন্তা করতে পারবে- এই ‘আইডিয়া’ সবার শুরুতে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী এলান টিউরিং।

“অনেক কল্প-বিজ্ঞান লেখক আছেন, যারা একই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। কিন্তু তারা নিজেরাও বিষয়টি সিরিয়াসলি নেননি, কারণ তাদের গল্পের যন্ত্রেরা বুদ্ধিমান হয়ে উঠতো জাদুমন্ত্রে। টিউরিংই প্রথম ব্যাখ্যা করেন- যন্ত্রকে দিয়ে কীভাবে চিন্তা করানো যেতে পারে।”

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের সদস্য মিনস্কি ১৯৭০ সালে ‘কম্পিউটারের নোবেল’ হিসেবে খ্যাত ‘এসিএম টিউরিং’ পুরস্কার পান।

এছাড়া এমআইটি কিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড, জাপান প্রাইজ, আইজেসিএআই রিসার্চ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড, র‌্যাংক প্রাইজ, রবার্ট উড প্রাইজ ফর অপটো-ইলেকট্রনিক্স ও বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, মিনস্কির খ্যাতি প্রযুক্তি জগতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘২০০১: এ স্পেস অডিসি’ নির্মাণের আগে পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ও ‘ভবিষ্যতের প্রযুক্তি’ সম্পর্কে ধারণা নিতে বেশ কয়েকবার মিনস্কির শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

১৯৫২ সালে মনোবিদ গ্লোরিয়া রুডিসের সঙ্গে ঘর বাঁধেন মিনস্কি। এমআইটির ছাত্রদের কাছে তার পরিচয় ছিল ‘সন্ধ্যার পরও ল্যাবে আটকে রাখা’ অধ্যাপক হিসেবে। তার সেই ছাত্ররাও পরবর্তী জীবনে কম্পিউটার প্রকৌশলের এক একজন তারকা হয়ে উঠেছেন।

উদ্ভাবক রে কার্জউইল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খ্যাতিমান গবেষক এমআইটির অধ্যাপক জেরাল্ড সাসম্যান এবং এমআইটি ল্যাবের বর্তমান প্রধান প্যাট্রিক উইনস্টনও অধ্যাপক মিনস্কিরই ছাত্র।

তার আরেক বিখ্যাত ছাত্রের নাম ড্যানি হিলিস, যার কোম্পানি থিংকিং মেশিনস করপোরেশন ১৯৯০ এর দশকে সুপারকম্পিউটার বানানো শুরু করে।

এক সাক্ষাৎকারে নিজের গুরুকে স্মরণ করে হিলিস বলেন, “মার্ভিনই আমাকে শিখিয়েছে, কী করে চিন্তা করতে হয়।”

স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও চার নাতি-নাতনী রেখে গেছেন অধ্যাপক মিনস্কি। আর রেখে গেছেন বহু ছাত্র-ছাত্রী, যারা যন্ত্রকে ‘বুদ্ধিমান’ বানানোর কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।  

বন্ধু ও সহকর্মী বিজ্ঞানী অ্যালান কের ভাষায়, “মিনস্কি কখনো ভাবতে পারত না যে তার কোনো কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে।”