‘অন্যায় করলে বিচার হোক, বাড়িতে আগুন দিল কেন?’

ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পদক্ষেপ, নিরাপত্তার আশ্বাসেও আতঙ্ক কাটছে না সেখানকার হিন্দুদের।

নড়াইল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2022, 01:47 PM
Updated : 18 July 2022, 06:28 AM

শুক্রবার রাতে উপজেলার দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় এ ঘটনার পর শনিবার দিনভর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গ্রামের রাস্তায় টহল দিয়েছে; যদিও অধিকাংশ হিন্দু বাড়িই ছিল প্রায় ফাঁকা। তার মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি ও হামলার শিকার মন্দির মেরামতের কাজ শুরু করেন ভুক্তভোগীরা।

বিকালে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও মন্দিরে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সব ধরনের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন।

দিঘলিয়া গ্রামটি বেশ বড়। গ্রামে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার বাস করে। এর মধ্যে বাজারের পাশেই সাহাপাড়ায় শতাধিক হিন্দু পরিবার যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করে এলেও কোনোদিন তারা এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হননি; বরং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সহাবস্থানের কথাই বলেছেন। কিন্তু শুক্রবারের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা তাদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।

মর্মামত জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফিও আক্ষেপ করে ফেইসবুকে লিখেছেন, “ছেলেবেলা থেকে যে নড়াইলকে দেখে এসেছি, যে নড়াইলকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই নড়াইলের সঙ্গে এই নড়াইলকে আমি মেলাতে পারছি না।” 

রোববার সকালেও দিঘলিয়া বাজার ও সাহাপাড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীকে তৎপর থাকতে দেখা গেছে। যদিও মানুষের আনাগোনা ছিল কিছুটা কম। হামলার পর যারা বাড়িঘর ছেড়ে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। বাজারের কিছু দোকানও খুলেছে। বাড়ির নারী-পুরুষদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে দেখা গেছে।   

শনিবার সরজমিনে গেলে গ্রামবাসী জানিয়েছেন, গোবিন্দ সাহার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয় তরুণ সাহা, দিলীপ সাহা, পরান সাহাসহ কয়েকটি বাড়ি ও অশোক সাহার দোকান। এ ছাড়া দিঘলিয়া আখড়াবাড়ি সার্বজনীন দুর্গাপুর মন্দির এবং দুটি পারিবারিক মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে।

ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধাপাকা বাড়িটা আগুনের পোড়া সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের প্রতিটি কক্ষের আসবারপত্রসহ মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। আগুনে পোড়া ঘরের পাকা দেয়ালগুলোর দাঁড়িয়ে থাকলেও; উপরের টিনের চাল পুড়ে গেছে। সেসব স্তূপ হয়ে ঘরের মধ্যেই পড়ে ছিল।

তিনটি মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ভাঙা প্রতিমা মাটিতে পড়ে আছে। চেয়ার ও সাউন্ড বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে। পূজা ও প্রার্থনার জিনিসপত্র এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।  

গোবিন্দ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুক্রবার দুপুর থেকে ফেইসবুকে একটি পোস্ট নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা চলছিল। গ্রামের সামনে বড় রাস্তায় কিছু মানুষ মিছিল করছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতে যে আগুন দিবে, তা আমরা কখনও ধারণাও করিনি।”

“রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে ১২ থেকে ১৩ জন লোক এসে আমাদের বাড়ির তালা ভেঙে ফেলে। কিছু সময় পর আরও কয়েকজন আসে; তারা তখন সবাই মিলে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি আর আমার মা এ সময় পাশের আরেকটি ঘরে তালা দিয়ে বসেছিলাম। আগুন দিয়ে চলে যাওয়ার পর প্রতিবেশীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর মধ্যে আমাদের বাড়ির সবকিছু পুড়ে গেছে।”

গোবিন্দ সাহা আরও বলেন, “যদি কেউ অন্যায় করে থাকে তাহলে তার বিচার হোক। আমাদের বাড়িতে আগুন দিল কেন?

“এমপি মাশরাফিসহ সবাই এসেছিলেন। শুনেছি আরও নেতারা আসবেন। সরকারিভাবে ঘর ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই রাতের কথা মনে পড়লে আতকে উঠি।“

ফেইসবুককেন্দ্রিক আরেক পোস্টকে কেন্দ্র করে গত মাসে নড়াইলের সদর উপজেলায় মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর খবরে বেশ কিছু দিন থেকে আলোচনায় রয়েছে নড়াইল। এর মধ্যেই এই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলো।

স্থানীয় বাসিন্দা, বাজারের ব্যবসায়ী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহাপাড়ার বাসিন্দা ২০ বছরের আকাশ সাহার একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। এতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সমালোচনা চলতে থাকে। জুম্মার নামাজের পর থেকেই উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। আকাশের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে তাদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন একদল।

বিকালে উত্তেজনা আরও বাড়ে এবং সন্ধ্যায় তারা সাহাপাড়ার কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করে। এরই ধারাবাহিকতায় রাতে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাহাপাড়ার বাসিন্দারা।  

হামলার পর পরই সাহাপাড়ার নারী-পুরুষ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেন। এরপর সেখানে পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা আসেন। তারা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানায় পুলিশ। রাতে আকাশ সাহাকে না পেয়ে তার বাবা অশোক সাহাকে থানায় নেওয়া হয়। তিনি এখনও বাড়ি ফেরেননি।

মধ্যরাতে খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) মো. নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন। জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও ক্রাইম) মো. রিয়াজুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রদীপ্ত রায়, সহকারী পুলিশ সুপার প্রণব কুমার সরকার, কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনার পর থেকেই সাহাপাড়ায় ছিলেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।  

সাহাপাড়ার পলাশ সাহার বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তার চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন যাবৎ সুখে-দুঃখে হিন্দু-মুসলমান আমরা একই সঙ্গে চলি। এখানে আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি।

“কিন্তু হঠাৎ করে শুক্রবার রাতে একদল লোক এসে আমার বাড়িতে ঢুকে সবকিছু ভাঙচুর করে । আমরা সেদিনের কথা ‍কিছুতেই ভুলতে পারছি না।”

হামলাকারীরা পিটিয়ে শিক্ষক তরুণ কুমার সাহার মাথা ফাটিয়ে দেয়। তিনি তার ভাইকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন।

এই শিক্ষক বলেন, “শুক্রবার বিকেল থেকেই আমরা এলাকায় ছিলাম। সন্ধ্যার ঠিক পরে হঠাৎ করে কিছু লোক আমাদের বাড়ির পাশের মন্দিরে হামলা চালায়।”

“এ সময় তারা আমার ভাই কুমারেশ সাহাকে মারতে থাকে। আমি তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করে বলি, ওকে মারছো কেন? আমাদের অপরাধ কী? এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আমার ওপর হামলা করে। পিটিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়। আমি তো কাউকে চিনি নাই। এলাকায় আমার কোনো শত্রু নাই। আমি কার বিরুদ্ধে মামলা করব বলেন?” 

তিনি আরও বলেন, “আকাশ সাহা যদি সত্যি সত্যি অপরাধ করে থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। আমাদের এমপি মাশরাফি এসেছিলেন। তিনি আমাদের সাহস দিয়েছেন। সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করছি, নতুন করে আর কোনো ঘটনা ঘটবে না।”

তবে পরিস্থিতি শান্ত হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের লোকজনের এলাকায় থাকা প্রয়োজন বলে বোধ করছেন গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ চন্দ্র সাহা।

তিনি বলেন, “কেউ অন্যায় করে থাকলে তার বিচার হওয়া উচিত। তবে আমরা যারা নিরীহ আছি, আমরা চাই, এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের লোকেরা এলাকায় থাকুক।”

প্রবীণ বাসিন্দা প্রমিলা সাহা বলেন, “সেদিন রাতে খুবই ভয় পেয়ে গিছিলাম। কোথার থেকে কারা আইসে আমাদের মন্দিরের ইট-পাটকেল মারিছে। বাড়ি বাড়ি যাইয়ে ভাঙচুর করিসে; মারধর করিসে। এ ঘটনার বিচার করা উচিত।”

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শিবনাথ বাইন বলেন, “বিকালে বাজার থেকে শুনতি পারলাম, অশোক সাহার ছেলে আকাশ সাহা নাকি ফেসবুকে নবীকে নিয়ে কী নাকি লিখেছে। এসব নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে আমরা রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘরে ঘুমাতি যাই।”

“হঠাৎ করে রাত ৮টা, সাড়ে ৮টার দিকে শুনি আমাদের মন্দিরে কেউ ইট মারতিছে। তখন আমরা আর ঘর থেকে বের হয়নি। চুপচাপ করে থাকি। সে সময় আমার বাড়িতে ইট মারিছে। টিন ভাঙে গেছে।”

দিঘলিয়া বাজারের ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, “দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে আসছি। সেদিন ঘটনা যে কিভাবে ঘটেছে তা আমরা বুঝতেই পারলাম না।

“মহানবীকে (সাঃ) নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে অবশ্যই তার বিচার করতে হবে। কিন্ত এভাবে মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা আগুন দেওয়া ঠিক হয়নি। সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এমন শান্তি দিতে হবে যেন আগামীতে কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।”

লোহাগড়ায় থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল জানান, লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সালাউদ্দিন কচি নামের এক ব্যক্তি আকাশ সাহাকে আসামি করে গত ১৫ জুলাই রাতে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’ অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। খুলনা থেকে শনিবার রাতে তাকে আটক করা হয়েছে। সেই মামলাতেই আকাশকে আদালতে হাজির করা হবে।

নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।”

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রিয়াজুল  ইসলাম বলেন, “সেদিনের হামলার চেষ্টাকারীরা অধিকাংশই বাহিরের লোক। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।” 

লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও বাড়ি সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে।

সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা এলাকা পরিদর্শন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছেন।

গত ১৭ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত এক বক্তব্য নিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।

এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পুলিশে খবর দেন।

ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেইসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।

এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের মধ্যে এ ঘটনায় সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন