নোয়াখালীতে নির্ঝঞ্ঝাটে গরু কেনায় খামারে আগ্রহ ক্রেতাদের

নোয়াখালীতে হাটের ঝামেলা এড়াতে খামার থেকে পছন্দের গরু সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা; ফলে জেলার বিভিন্ন খামারগুলোতে কোরবানির গরু কেনাবেচা জমে উঠেছে।

নোয়াখালী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2022, 08:48 AM
Updated : 7 July 2022, 08:48 AM

জেলার বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখা যায়, তিনটি বড় খামারে কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা প্রায় অর্ধেক গরু ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।

খামার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খামারে গরু বেচাকেনায় দালাল বা মধ্যসত্বভোগী না থাকায় ক্রেতা বিক্রেতা কোন পক্ষকেই বাড়তি খরচ দিতে হচ্ছে না। পাশাপাশি হাট থেকে গরু কিনলে টোল বাবত শতকরা হারে যে টাকা দিতে হয়, খামারে তা লাগে না। তবে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এবার গরু মোটা তাজাকরণে খামারিদের এবার খরচ বেড়েছে।

এদিকে ঝামেলা ছাড়াই খামার থেকে পছন্দের গরু কিনতে পেরে খুশি ক্রেতারা। তারা বলছেন, অন্যান্য বারের অভিজ্ঞতা ভালো হওয়ায় এবারও খামারে আসছেন তারা। এখানে পছন্দসই গরু ঠিক করে বুকিং দিয়ে ঈদের আগ পর্যন্ত খামারেই রাখার সুবিধা পাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি ঈদের দিন সকালেও বাড়িতে গরু পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

নোয়াখালী সদর উপজেলার পশ্চিম চর উড়িয়া গ্রামে ‘মানফাত মিট-ক্যাটেল অ্যান্ড ডেইরি ফার্মে’ প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতারা গরু কিনতে আসছেন বলে ফার্মের মালিক পেশায় অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন জানান।

তিনি জানান, ২০১৮ সালে ৭ একর পতিত জমিতে ৮০টি গরু দিয়ে খামার শুরু করেন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। প্রতি বছর ঈদে ২০০ গরু বিক্রি হয় তার খামারে। তার খামারে শেডের ভেতরে প্রতিটি গরুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। গরুর গোসল, চিকিৎসা ও প্রজননের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

‘প্রাকৃতিক উপায়ে’ দেশি গরু মোটা তাজাকরণ ফার্মগুলোর মধ্যে বৃহত্তর নোয়াখালী ও বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এ খামারে গত পাঁচ বছর থেকে ‘লাইভ ওয়েট স্কেলে’ মেপে গরু বিক্রি করা হয়।

খামারটিতে এ বছর বিক্রির জন্য সর্বনিম্ন দুইশ কেজি থেকে সর্বোচ্চ সাতশ কেজি ওজনের দুইশ’টি গরু রয়েছে জানিয়ে শিহাব বলেন, “বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৯৮টি গরু বিক্রির জন্য বুকিং হয়েছে। এখানে প্রতি কেজি ষাঁড়ের মূল্য ৪৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি বলদের মূল্য ৪৮০ টাকা ধরা হয়েছে। এ হিসেবে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে খামারটিতে।”

মানফাত মিট-ক্যাটেলের শ্রমিক আবদুর রহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের কয়েক মাস আগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশি গরু সংগ্রহ করে এখানে আনা হয়। এরপর সরকারি পশু চিকিৎকদের তত্ত্বাবধানে দেশি খাবার ও রোগ বালাই প্রতিষেধক দিয়ে মোটাতাজা করে সেগুলো বিক্রি করা হয়।”

এ খামারের সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেকারো পছন্দ হবে বলেও জানান তিনি।  

রহিম আরও বলেন, “নোয়াখালীতে সর্বপ্রথম আমাদের খামারেই লাইভ ওয়েট স্কেলে মেপে গরু বিক্রি শুরু করা হয়। আমি মনে করি, বাজারে গেলে ক্রেতাদের নানাভাবে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে। কোরবানির হাটে দালাল থাকে, তারা মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে। খামারে ক্রেতারা পছন্দের গরু লাইভ ওয়েট স্কেলে কিনতে পারে।

“আমরা শতভাগ সুস্থ ও সুঠাম দেহের গরু দিয়ে থাকি। খামারে প্রতিদিন কমপক্ষে একবার আবার কখনও দুইবার গরুগুলোকে গোসল করানো হয় এবং যত্ন করা হয়। এখানে গরুগুলোকে ঘাসের চাষ করা ঘাসের পাশাপাশি খর, ভুসি ও নিরাপদ পোল্ট্রি ফিড খাওয়ানো হয়।” 

গরুর বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এবার গরু মোটা তাজাকরণে খামারিদের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ খরচ বেড়েছে। যার কারণে গরুর বাজার দরের ওপরে এর প্রভাব পড়েছে। এরপরও নিছক লাভের চিন্তা না করে পবিত্র ঈদে কোরবানির জন্য মানুষকে সুস্থ-সবল গরু দিতে পেরে মানসিক প্রশান্তির পাওয়াই আমাদের মূল্য লক্ষ্য।”

মানফাত মিট-ক্যাটেল খামারে কথা হয় সদর উপজেলার অশ্বদিয়া ইউনিয়ন থেকে গরু কিনতে আসা কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, “হাটে অনেক গরু থাকলেও দালালদের কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়। দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত পছন্দের গরুই কেনা সম্ভব ওঠে না। তাই ঝামেলা এড়াতে এখানে আসলাম। দরদাম মিললে গরু বুকিং দিয়ে যাব, ঈদের আগের দিন বাড়িতে নিয়ে যাব। এতে কিছু টাকা বেশি লাগলেও বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে না।”

নোয়াখালী জেলার আরও একটি বড় গরুর ফার্ম হচ্ছে বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুরের নাওয়াফ এগ্রো ফার্ম। এর ব্যবস্থাপক মো. শাহাব উদ্দিন জানান, তার খামারে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে দেশীয় খাবার দিয়ে এবার তিনশ গরু কোরবানির জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে; গরুগুলো বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। এ ফার্মে ৩'শ থেকে ১১'শ কেজি ওজনের গরু রয়েছে; দাম হাঁকা হচ্ছে এক লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত।

বুধবার পর্যন্ত খামারের অর্ধেক গরু বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানালেন তিনি। 

বিদেশী গরু না আসায় দেশী গরুর চাহিদা বেড়েছে জানিয়ে শাহাব বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী এবার ফার্মে গরুর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তবে শেষ মুহুর্তে যেন বিদেশি গরু আসতে না পারে সেদিকে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার। তা না হলে খামারিরা লোকসানের মুখে পড়ে হতাশ হবে।”

এ খামারের ক্রেতা বেগমগঞ্জের আলীপুরের আবু রায়হান সরকার বলেন, “করোনা পরিস্থিতি এখনও ভালো হয়নি। ঝুঁকি নিয়ে হাটে বাজারে যাওয়ার চেয়ে বাড়ির পাশের খামার থেকেই গরু কিনতে এলাম। এখানে ওজন পরিমাপ করে পছন্দের কিনতে পরছি; প্রতারিত হওয়াও সম্ভবনা দেখছি না। তাই খামারই সবদিক থেকে ভালো।”

সোনাইমুড়ি উপজেলার চাষিরহাট ইউনিয়নের পোরকরা গ্রামের মেকদাদ অ্যান্ড হেমরাদ এগ্রো ফার্মে ঘুরে দেখা গেছে, ১৩০টি গরু কোরবানির উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে। লাইভ ওয়েট স্কেলে ৪৫০ থেকে ৪৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে গরুগুলো।

এ ফার্মে জেলা সদর থেকে গরু কিনতে আসা মো. সেলিম জানালেন, গত চারদিন বিভিন্ন বাজার ঘুরে পছন্দের গরু না পেয়ে তিনি এখানে এসেছেন। তবে এ খামারে বড় গরুর দাম কম হলেও মাঝারি ও ছোট গরুর বেশ দাম। তারপরও এক লাখ টাকায় মনের মত গরু কিনতে পেরে তিনি খুশি। 

মেকদাদ অ্যান্ড হেমরাদ এগ্রো ফার্মে ৭০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে বলে খামারের পরিচালক মো. মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত খামারের ৯০টি গরু বিক্রি হয়েছে।

মহিউদ্দিন বলেন, “আমাদের খামারের গরুগুলো রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিয়মিত যত্ন করা হয়। সরাসরি খামারে এসে অথবা অনলাইনে গরু কেনার সুযোগ রয়েছে।”

নোয়াখালীতে কোরবানির জন্য এবার ১ লাখ গবাদি পশু লালন পালন করা হচ্ছে, যা জেলায় চাহিদার চেয়ে ১০ হাজার বেশি বলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কাজী রফিকুজ্জামান জানান। 

তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের সহায়তায় কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা বিক্রেতাদের সুবিধার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”

এছাড়া প্রাণিসম্পদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে একাধিক অনলাইন প্লাটফর্মে পশু বেচাকেনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।