বন্যা: নেত্রকোণায় ডায়রিয়া আক্রান্ত ঘণ্টায় ৩ জনের বেশি

নেত্রকোণায় বন্যা দুর্গত এলাকায় একদিকে বাড়ি-ঘর থেকে পানি নামছে আরেকদিকে বাড়ছে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগ। জেলায় প্রতি ঘণ্টায় তিনজনের বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

নেত্রকোণা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2022, 02:37 AM
Updated : 6 July 2022, 04:55 AM

স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৮৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন, অর্থ্যাৎ ঘণ্টায় গড়ে সাড়ে তিন জন। এ ছাড়া পেটের পীড়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, চর্মরোগ, জ্বর, মাথাব্যথাতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।

জেলা সিভিল সার্জন মো. সেলিম মিয়া বলেন, “জেলায় গত এক মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৫৩৭ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৪৭৩ জন। ৪৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।“

এ বছর বন্যায় উত্তর পূর্বাঞ্চলের যে তিন জেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে নেত্রকোণা অন্যতম। জেলার সবকটি উপজেলাই বন্যা কবলিত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় হাওর সংলগ্ন উপজেলা খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দা ও মোহনগঞ্জ।

এ সময় হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে বাধ্য হয়। পানি নামার পর মানুষ বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরলেও ডায়রিয়াসহ নানা রোগের কবলে পড়ে।

কলমাকান্দা উপজেলার পাগলা এলাকার মধ্যবয়সী কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, “বন্যার পরে অহন পানি নামতাছে। অসুখ-বিসুখ অইতাছে। আমরার ঘরে দুই পোলাপানসহ বউয়ের জ্বর, চুলকানি অইছে।”

“আমারও পেটটা ভালা না। সরকারি মেডিকেল টিমের লোকজনের দেহা পাইছি না। ফার্মেসি থেইক্যা আইন্যা ওষুধ কাইতাছি। অহন ভালার দিকে।”

হাওর অধ্যুষিত উপজেলা খালিয়াজুরীর সরকারহাটি গ্রামের বাসিন্দা টুকটুকি সরকার (৩২) বলেন, “পাতলা পায়খানা অইতাছিল। পরে সরকারি ওষুধ পাইছি। ডাক্তারও দেহাইতাম পারছি। অহন ভালাই আছি।”

একই কথা জানান উপজেলা সদরের পুরাণহাটির বাসিন্দা জুলেখা আক্তার (৫৫) ও কাদিরপুরের সরস্বতী রাণী দাসও (৬০)।  ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচদিন ভোগার পর তারা এখন সুস্থ।

বন্যার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে আছেন উপজেলার আদমপুর গ্রামের যুবক সাগর সরকার। তিনি বলেন, “বানের পানিতে হাতে পাওয়ে চর্মরোগ অইছিলো। অহন কিছুটা ভাল অইছি।”

তবে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ নাগাদ দেড় লাখ ওআরএস স্যালাইন ও দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। মোট ৯৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে দুর্গত এলাকায়। জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় সেনা সদস্যরাও স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।

জেলা সিভিল সার্জন মো. সেলিম মিয়া জানান, জেলা স্বাস্থ্যবিভাগে দুই লাখ ৫২ হাজার (খাবার স্যালাইন) ওআরএস স্যালাইন, ১০০০ এমএলের এক হাজার ৪৯৮ ব্যাগ, ৫০০ এমএলের তিন হাজার ১৭৬ ব্যাগ আইভি ফ্লুইড স্যালাইন মজুদ রয়েছে। তাছাড়া ৬৮ হাজার ৯০০ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, সাপের বিষ প্রতিরোধক ৩৭০ ভায়েল ইনজেকশনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রয়েছে।

তিনি আরও জানান, জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে ১৬ জন মারা গেছেন। ত্রাণ বিতরণের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন মারা গেছেন। বানের পানি ঢুকে পড়ায় নয়টি কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান ব্যাহত হয়েছে।

“বন্যা দুর্গত এলাকায় পানি নামার সময়ে রোগবালাই বেশি হয়। বর্তমান সময়টাতেই বেশি চ্যালেঞ্জ। জেলার দুর্গত এলাকায় মেডিকেল টিমের সদস্যরা রাত-দিন কাজ করছে। তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ দিচ্ছেন।”

কেউ যদি তাৎক্ষণিক মেডিকেল টিমের সদস্যদের না পান তাহলে ঘরে বসে না থেকে দ্রুত কাছের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার আহ্বান জানান সিভিল সার্জন।

জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও দুর্গত এলাকার বানভাসি মানুষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুন রাতে হানা দেওয়া বানের পানিতে নেত্রকোণার ১০ উপজেলার ৭৭টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এতে প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হন। ক্ষতিগ্রস্ত হন পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫০ জন মানুষ ।

খোলা হয় ৩৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে আশ্রয় নেন প্রায় সোয়া লাখ মানুষ। বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দেয় খাদ্য সংকট, অভাব দেখা দেয় গোখাদ্যের ।

বন্যা শুরুর দুই দিনের মাথায় জেলা প্রশাসকের আহ্বানে খালিয়াজুরী উপজেলায় বন্যার্তদের উদ্ধার ও সেবায় কাজ শুরু করেন সেনা সদস্যরা। পরে সেনা সদস্যরা আরো তিনটি উপজেলায় কাজ শুরু করেন।

এরমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৭৯৮ মেট্রিক টন জিআর চাল, শিশু ও গোখাদ্যসহ নগদ এক কোটি ৩ লাখ টাকা, সাত হাজার ১১৫ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

জেলা পরিষদের প্রশাসক প্রশান্ত রায় জানান, সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারের মাঝে মুড়ি, চিড়া, চিনি, বিস্কুট, স্যালাইনসহ শুকনো খাবার, এক হাজার ৮০০ পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, দুধ, সেমাইয়ের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া নেত্রকোণা পৌরসভা, জেলা রেডক্রিসেন্ট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও বেসরকারি সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করছেন।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, বন্যায় কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। বন্যার শুরু থেকেই ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছ। বন্যার্তদের সার্বিক দেখভাল করছে প্রশাসন।

আরও পড়ুন: