‘বম পার্টি’র ভয়ে বিলাইছড়ির ত্রিপুরা-তঞ্চঙ্গ্যারা ‘উদ্বাস্তু’ জীবনে

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় তিন জন খুন হওয়ার পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় নিজেদের ঘরে ফিরছেন না ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়াদের কয়েকটি পাড়ার মানুষ।

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2022, 06:51 PM
Updated : 5 July 2022, 06:51 PM

কয়েক মাস আগে একবার হুমকি পেয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন এই জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো। কিছুদিন পর কয়েকটি ফিরেছিল। কিন্তু গত ২১ জুন বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নে দুর্গম সাইজাম পাড়ায় তিন ত্রিপুরাকে হত্যার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক চেপে বসেছে।

ওই হত্যাকাণ্ডের পর দায় স্বীকার করে ফেইসবুকে বার্তা এসেছিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নামে, যা পাহাড়িরা ‘বম পার্টি’ নামে চেনে।

গত এপ্রিলে একটি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের বিভাজিত রাজনীতির মধ্যে নিজেদের অস্তিত্বের জানায় দেয় এই ‘বম পার্টি’। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে- ‘কুকি-চিন রাজ্য’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না, থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।

হুমকির মুখে গত এপ্রিল থেকেই ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বিলাইছড়ি থেকে ছাড়তে শুরু করে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

পাহাড়িদের গ্রামগুলো সাধারণত কয়েকটি পরিবার নিয়ে হয়ে থাকে। যাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে জুমচাষ। সেই চাষের জমি আর গবাদিপশু ফেলেই কয়েকটি গ্রামের মানুষ ‘উদ্বাস্তু জীবনে’ যেতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

এমন মানচিত্রের রাজ্য চায় কেএনএফ।

বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতুমং মারমা জানান, তার এলাকা থেকে ‘কুকি-চিন পার্টির হুমকির মুখে’ পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে মোট ৮৮টি পরিবার।

এর মধ্যে বরইক্যাছড়াপাড়া ৩৬টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার, সাইজামপাড়া বম, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা মিলে ২২টি পরিবার, বিলপাড়া ১৯টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার ও কাইংগছড়াপাড়া ১১টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার।

দুর্গম ওই এলাকায়, যেখানে হেঁটে যাওয়ার বিকল্প নেই, আর তাতেও কয়েকদিন লাগে, সেখানে গিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি যাচাইয়ের সুযোগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পায়নি।

অন্যদিকে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য লালসম লিয়ান বম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ওয়ার্ডে মোট নয়টি পাড়া রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ পরিবারের প্রভাতচন্দ্র পাড়াটির সবাই পালিয়েছে।

“কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সদস্যরা হুমকি দেওয়ার কথা বলেছে পাড়ার লোকজন।”

তবে বম, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ও পাংখোয়া মিলে আরও আটটি পাড়ার লোকজন এখনও সেখানে অবস্থান করছে বলে জানান ইউপি সদস্য লালসম লিয়ান বম।

তবে তিনি বলেন, “এলাকাটি মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে এবং অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় অন্যদের পরিস্থিতি জানার সুযোগ নেই।”

রোয়াংছড়ি সদর থেকে সেখানে পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে আট থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে বলে জানান লালসম লিয়ান বম।

পাড়াছাড়া এসব পরিবারের মধ্যে অন্তত ২৪টি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলায় এবং অন্য পরিবারগুলো রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের কয়েকটি পাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে খামতাং পাড়ার কারবারী মানিক খিয়াং বলেন, বিলাইছড়ি সাইজাম পাড়া থেকে পালিয়ে এসে তার পাড়ায় খিয়াং সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

ভিটেমাটি ছেড়ে আসা এসব পরিবার অনেকটাই ‘উদ্বাস্তুর মতো’ জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে তারা গ্রামেও ফিরে যেতে পারছেন না। ফলে আয়-উপার্জনহীন অবস্থায় অনেকটা দুর্বিষহ দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। অনেকে বাধ্য হয়ে যানবাহনে শ্রমিকের কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।

ক্যাপলাং খিয়াং পাড়ায় আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি পরিবারে মধ্যে একজন পাড়াপ্রধান বা কারবারীও রয়েছেন। তিনি এখন রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরে থ্রি হুইলার টমটম গাড়ি চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

গ্রাম ছেড়ে আসা অনেকের দেখা পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তারা ‘প্রাণের ভয়ে আছেন’ জানিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। কয়েকজন কথা বললেও বার বার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন।

এমনই একজন সোমবার দুপুরে বলেন, “তিন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যার পর এমনিতে ভয়ে ছিলাম। পরে আমাদের এলাকায় এসে (বম পার্টি) হুমকি দেওয়া শুরু করে। বলে দেওয়া হয়, তিন দিনের মধ্যে পাড়া ছেড়ে না গেলে ওই ত্রিপুরাদের মতো গুলি করে মেরে ফেলা হবে।

“৩০ জুন ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে প্রায় আট ঘণ্টা হেঁটে পাড়ার পাঁচটি পরিবার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উঠি। জুমধান, গরু, ছাগল, মোরগ ও শুকর সবকিছু ফেলে চলে আসতে হয়েছে। এখন দিনমজুরি করে চলতে হচ্ছে।”

বিলাইছড়িতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বান্দরবানে ত্রিপুরাদের মানববন্ধন। ফাইল ছবি

আরেকজন বলেন, “বাচ্চাদের তো খাওয়াতে হবে। এভাবে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কতদিনই বা থাকব। এখন বাধ্য হয়ে দিনমজুরি করতে হয়।”

পরিবার নিয়ে যে এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পরিবার প্রতি ১০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। এর বাইরে এখনও পর্যন্ত কেউ খবর নেয়নি বলেও জানান ওই পাড়াবাসী।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিলাইছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনপ্রতিনিধির কাছে শুনেছি। তবে কত পরিবার পালিয়ে গেছে সঠিক করে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যাচ্ছে না।”

পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বান্দরবানের রুমা হয়ে পুলিশের দলটি ঘটনাস্থলে গেছে। রুমা থেকেই পায়ে হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দুদিন লাগে। আসা-যাওয়া মোট চার দিন সময় যাবে।

“এত দুর্গম এলাকার পাহাড়ি পথ; আবার একটানা পায়ে হাঁটা। নিরাপত্তার বিষয়ও জড়িত। সবকিছু মিলে দলটি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখনও বিস্তারিত কিছুই বলা যাচ্ছে না।”

বান্দরবান জেলায় পালিয়ে আসা লোকজন সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলার পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনাদের (সাংবাদিক) সবার কাছে এরকম শুনেছি। এখনও পর্যন্ত কেউ থানায় এসে কোনো অভিযোগ করেননি। কেউ অবহিতও করেননি। থানায় এসে কেউ অভিযোগ করলে নিশ্চয়ই খোঁজখবর নেওয়া হবে।”

যে ‘বম পার্টি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের কেউ প্রকাশ্য নয় বলে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তাদের ফেইসবুক পাতায় এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের লড়াই ত্রিপুরাদের বিরুদ্ধে নয়।

কেএনএফ তাদের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের’ জন্য জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছেন।

জনসংহতি সমিতি সম্প্রতি রাঙামাটির বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা জুমচাষিদের উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।

আরও পড়ুন