বানভাসিদের দিনলিপি: ভিটাই ভেসে গেছে সাগরের, আনোয়ারাদের ঘর-খোরাকি সবই

ভিটের মাটি নেই, একপাশের বেড়াও গেছে ভেসে; সিমেন্টের পিলারের উপর টিনের ছাউনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন শুধু একটি ঘরের ‘কঙ্কাল’।

মাসুম বিল্লাহ সুনামগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2022, 08:20 PM
Updated : 2 July 2022, 09:15 PM

দেখে মনে হতে পারে, হাওরের পাশে কোনো এক পরিত্যক্ত ঘর, যেখানে বেশ কয়েকদিন কারও পা পড়েনি। অথচ ১৭ দিন আগেও এ জায়গায় ছিল সাগর মিয়ার তিন সদস্যের সুখের সংসার; কোলাহলে পূর্ণ এক আঙিনা।

আসাম ও মেঘালয় থেকে ধেয়ে আসা ঢলের সেই দিনটিতে বাড়িতে ছিলেন না সাগর। মধ্য জুনের সেই রাতে বানের তোড়ের মধ্যে দেড় বছরের সন্তানকে নিয়ে পাশের বাড়িতে কোনো রকমে আশ্রয় নেন তার স্ত্রী জরিমন বেগম।

২৫ বছরের যুবক সাগর মিয়া বলেন, এমন স্রোত যে ওদের প্রাণ বাঁচে না, ঘর আর রক্ষা করবে কি… সবই ভেসে গেছে। ফিরে এসে দেখি ভিটের মাটিও নাই!

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তার আক্ষেপ এই বৈশাখেই ৪০ হাজার টাকা খরচ করে হাওর থেকে মাটি এনে ভিটায় ফেলেছিলেন। নতুন করে এক পাশে বারান্দা করার ইচ্ছা নিয়ে তিন বান টিনও কিনে রেখেছিলেন তিনি।

তৃতীয় দফার বন্যায় সব কিছুই ভেসে গেছে এক রাতের দুর্যোগে; বানের এমন তেজ আর দেখেননি যুবক সাগর, পানির মধ্যেই যার এখন কাটে রাতদিন আর শৈশব কৈশোরও কেটেছে হাওরেই।

ভিটের মধ্যে বারান্দা করার জন্য যে জায়গা ভেবেছিলেন সাগর, সেটা স্রোতের ধাক্কায় বিলিন হয়েছে টাংগুয়ার হাওরে। ঘরের সীমানার সঙ্গে এখনও ছুঁই ছুঁই করছে পানি।

মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী সাগরের কাছে বারান্দা তৈরি এখন দূরের প্রশ্ন। বর্ষার মধ্যে ভিটের মাটি কোথা থেকে জোগাড় করবেন, টাকাই বা পাবেন কই- সেই চিন্তাতেই বানভাসি দিনগুলো কাটছে তার।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রতিবেশী চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে আর কয়দিন থাকা যায়- এমন অস্বস্তির মধ্যে চারিদকে থৈ থৈ পানির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন মাত্র দেড় মাস আগে বাবাকে হারানো সাগর।

কিছু বুঝে ওটার আগেই উজানের অতিবৃষ্টিতে ঢল হয়ে নেমে আসা এ বন্যায়

ঘর হারিয়ে সুনামগঞ্জের এই যুবক একই যে শুধু দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন তা নয়, তার মতো হাজারো মানুষ ঘরহারা হয়েছেন।

মধ্য জুনের এ বন্যায় হাওরের এ জেলার বেশির ভাগ বাড়িঘর গেছে তলিয়ে; এমনকি একদিনের ব্যবধানে জেলা শহরের প্রতিটি একতলা বাড়িতে ঢুকেছে পানি। দুদিন ধরে শুকনো আশ্রয়ের জন্য এদিক সেদিক ছুটেছেন সচ্ছল-অসচ্ছল সব ধরনের মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে পানিবন্দিদের সরাতে নামতে হয়েছি সেনাবাহিনীকে।

সরকারি হিসাব বলছে, সুনামগঞ্জে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এ বন্যায় সাগরের মতো ৪৫ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এখনও ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি পরিসংখ্যানের বাইরে রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে আরও এক মাস সময় লাগবে বলে প্রশাসনের ভাষ্য।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শুক্রবার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বন্যায় এ জেলায় এবার বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে চার হাজার ৭৪৫টি পরিবারের বাড়িঘর। আর ৪০ হাজার ৫৪১টি পরিবারের ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত।

তাহিরপুর উপজেলায় টাংগুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার কাছাকাছি সাগরদের উত্তর শ্রীপুর এলাকা। ইঞ্জিনচালিত ছোটো নৌকায় সেখানে যেতে লাগে ঘন্টাখানেকের মত।

স্থানীয়রা জানান, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিক থেকে তালিকায় প্রথম দিকে থাকবে সাগরদের উত্তর শ্রীপুর এলাকা। এখানকার অধিকাংশ ঘর আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

একই এলাকায় সাগরদের ঘরের কিছুটা দূরে আনোয়ারা বেগমের পুরো ঘরই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে; বানের তোড়ে ভেসে গেছে বেশিরভাগ জিনিসপত্র। খোরাকির ২০-২২ মণ চালও গেছে হাওরের জলে হারিয়ে।

ওই ঘরে ছেলে, ছেলের বউ আর চার নাতি-নাতনীর সঙ্গে থাকতেন আনোয়ারা। ছেলে সবুজ মিয়ার কৃষিকাজের মাধ্যমে স্বাচ্ছেন্দেই সংসার চলছিল তাদের।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

১৬ জুন বন্যার পর থেকে ওই গ্রামেই কিছুটা উঁচুতে থাকা দেবরের পাকা বাড়িতে আশ্রয়ে নিয়েছিলেন। নিজের বাড়িতে তারা ফিরেছেন গত বৃহস্পতিবার।

শনিবার বন্যার ১৭ দিন পর তাহিরপুরের গোলাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের টিন, লেপ-তোষক আর হাড়ি-পাতিল কুড়িয়ে জড়ো করছেন মা-ছেলে। যেগুলো গাছে আটকে জটলা বেঁধে ছিল ভেসে যাওয়া ভিটের পাশেই।

ঘর হারানো আর পানিবন্দি হয়ে গত কয়েক দিনের নিদারুণ কষ্টের বর্ণনা দিয়ে ৭০ বছর বয়সি আনোয়ারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমার জীবনে এমন বন্যা দেহি নাই। বাপ-দাদার মুখেও এরকম বন্যার কথা শুনি নাই। বান আমাগো ঘরটাই নিয়ে গেল।

গোলাবাড়ি গ্রামের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে শুকিলা বেগমের ঘরের পেছন বারান্দা আর রান্নাঘর ভেসে গেছে বানের জলে; তছনছ হয়েছে পাঁচ কক্ষের ঘর। স্রোতের ধাক্কায় ঘরের পেছন দিকের ১০ হাতের মত জায়গা বিলীন হয়েছে হাওরের মধ্যে।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বেড়া ভেঙে ভেসে গেছে ঘরের জিনিসপত্র; আসবাবপত্র হয়েছে চুরমার। পানি নেমে যাওয়ার কয়েকদিন পর এসে ঘরে কাদার মধ্যে পাটি বিছিয়ে দিনাতিপাত করছে এ পরিবার।

ঘরের মধ্যে শুধু আস্ত আছে ধানের গোলা, যা এ বছর খালিই পড়ে আছে। কারণ, ফাল্গুন মাসে পানিতে ডুবে যাওয়ায় ধান কেটে আর ঘরে তুলতে পারেননি তারা।

শুকিলা বলেন, বন্যার পানি যখন ’গায়ে কাঁপন’ ধরিয়ে আসল, তখন ঘরের শিশুদের রাখা হয়েছিল ধানের খালি গোলার মধ্যে। অন্যদিকে, ভেসে গেছে ’আমাদের সবকিছু’।

শনিবার বিকালে যখন গোলাবাড়ি গ্রামের শুকিলার সঙ্গে কথা হয়, তখন ভেসে যাওয়া বারান্দার জায়গায় রান্না করছিলেন তিনি। রান্নাঘর ভেঙে যাওয়ার পর কয়েকদিন টিনের চুলায় রান্না করেছিলেন তারা। এখন রান্না হয় ইট বিছিয়ে তৈরি চুলায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মধ্যবয়সী এ নারী বলেন, সব তো নিয়ে গেছে বন্যায়। জানি না, কখন ঠিক হবে ঘর আর একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব, থাকতে পারব ঘরে; আগে যেমনটি ছিলাম।

আরও পড়ুন