যাদের ছোট নৌকা আছে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণবাহী নৌকার পিছু নিয়ে একাধিকবার আদায় করে নিচ্ছে। আবার একাধিকবার পেয়েও অনেককে ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করতে দেখা গেছে।
তাই ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার অভিযোগও উঠেছে।
সরেজমিন বুধবার সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের বৈঠাখালি পয়েন্ট, সুনামগঞ্জ পৌরসভা চত্বর ও মল্লিকপুর এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
এসব এলাকার নানা বয়সী মানুষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে ত্রাণ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন।
এমন কয়েকজন মধ্যবয়ষ্ক ও বৃদ্ধা নারীকে বৈঠাখালি এলাকায় ত্রাণের জন্য বসে থাকতে দেখা গেছে।
এ সময় কথা হয় রঙ্গারচর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের বিলাল মিয়ার স্ত্রী সত্তরোর্ধ্ব জমিলা বিবির সঙ্গে। তিনি ইতোমধ্যে চারবার ত্রাণ সামগ্রী পেয়েছেন বলে জানান। এর মধ্যে দুই প্যাকেট শুকনো খাবার ও দুই প্যাকেট চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্য রয়েছে। তারপরও তিনি ত্রাণ পরিবহনের পয়েন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বৈঠাখালী পয়েন্টে এসে সকাল থেকে বসে থাকেন।
জমিলা বিবি বলেন, “চিড়া, মুড়ি, গুড়, মোম, ম্যাচ, স্যালাইনসহ দুই প্যাকেট পেয়েছি। আর চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু পেয়েছি আরও দুই প্যাকেট। আমার পরিবারে মানুষ বেশি তাই আমার চাহিদাও বেশি।
বন্যায় তার বসতঘর, বাসনকোসন ও মজুদকৃত খাবার নষ্ট করে গেছে বলে জানান এই নারী।
তার পাশেই বসেছিলেন রহিমা বিবি (৭০) নামের একই গ্রামের আরেক নারী।
তিনি বলেন, এখন চারদিকে পানি থাকায় নৌকা করেই ত্রাণ দেওয়া হয়। যাদের ছোট ছোট নৌকা আছে তারাই বারবার ত্রাণবাহী নৌকার পিছু নিয়ে ত্রাণ আদায় করে নিচ্ছে। ডাঙ্গায় ত্রাণবাহী নৌকা লাগালে ত্রাণ নিতে আসা লোকজন ভিড় জমানোয় বণ্ঠন না করেই অনেকে চলে যান। তাই এই সুযোগ নিচ্ছে যাদের ছোট ছোট নৌকা আছে সেই লোকজন।
তিনি বলেন, “আমি মাত্র একবার শুকনো এক প্যাকেট খাবার পেয়েছি। আমাদের গ্রামের যাদের নিজেদের ছোট ছোট নৌকা আছে তারা ৪-৫ বার করে ত্রাণ পাচ্ছে।”
সুনামগঞ্জ শহরে মল্লিকপুর বিজিবি ক্যাম্পের গেটের সামনে ত্রাণের আশায় বসে আছেন কয়েকজন। এর মধ্যে শহরের তেঘরিয়া এলাকার বাসিন্দা নূর হোসেনও আছেন।
তিনি একবারও ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন।
কিন্তু এই প্রতিবেদক এর আগে তাকে বিজিবির কাছ থেকে দুই প্যাকেট ত্রাণ নিতে দেখেছেন – এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি কোনো কথা না বলেই সটকে পড়েন।
তিনি বলেন, “সবাই ত্রাণ পাচ্ছে। আমার দুর্ভাগ্য বাড়িতে ও শহরে কোথাও ত্রাণ পাইনি। বাড়িতে মেম্বার চেয়ারম্যান আমাকে কোনো ত্রাণ দেয়নি।”
তার পাশেই দাঁড়ানো একই উপজেলার পলাশ এলাকার মৃত শামসুদ্দিনের ছেলে রিকশা চালক হযরত আলী বলেন, “আমি একবারও ত্রাণ পাইছি না। আমার বাড়িতেও কেউ দিছে না। এখন ত্রাণ দিচ্ছে দেখে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছি। জানি না পাব কি না।”
এ সময় লাইনে দাঁড়ানো একাধিক বানভাসি মানুষ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা করেন।
হযরত আলী বলেন, “মেম্বার-চেয়ারম্যান তাদের আত্মীয়-স্বজন ও ভোটার দেখে ত্রাণ দেয়।”
বন্যায় ঘরের সবকিছু নষ্ট করে গেছে। তাই ঘরে খাদ্য না থাকায় মঙ্গলবার তিনি সুনামগঞ্জ শহরে স্বামী আপিল উদ্দিনের সঙ্গে এসেছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “আমি ও আমার স্বামী এখনও একবারও ত্রাণ পাইনি।”
প্রতিবন্ধী দেড় বছরের নাতনিকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “আমার ছেলে শফিকের মেয়ে সে। পুত্রবধূ রোকসানা সাতদিনের মেয়েকে রেখে মারা গেছে। এখন আমি তাকে লালনপালন করি। আমার ছেলের পা ভাঙা, বাড়িতে বসে থাকে। কিছু করতে পারে না। তাই অনেক কষ্টে আমাদের দিন যায়।”
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেনরায় বলেন, “সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে আমরা মানববন্ধন করেছি।”
বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতায় সমন্বয় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ত্রাণ পাচ্ছে, একাধিকবার পাচ্ছে। আবার অনেক হতদরিদ্র বানভাসি অসহায় পরিবারের লোকজন একবারও ত্রাণ পায়নি। তাছাড়া ত্রাণের বিপুল চাহিদা থাকায় বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিশৃঙ্খলার কারণে অনেকে ত্রাণ না দিয়েও চলে যাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। আশ্রয় কেন্দ্র ও আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরের বানভাসিদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বেসরকারি ত্রাণ দাতাদের ত্রাণের সমন্বয় ঠিক রাখতে আমরা জেলার এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত শান্তিগঞ্জে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের মাধ্যমে বেসরকারি ত্রাণের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের দুর্গম এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”