হেনস্তার শিকার সেই শিক্ষক এখনও ভয়ে, ফিরছেন না বাড়িতে

নড়াইলে হেনস্তার শিকার কলেজ শিক্ষক এক সপ্তাহ পরও ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়; যদিও তার বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসেছে।

নড়াইল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2022, 06:16 PM
Updated : 28 June 2022, 07:54 AM

সারাদেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে এই ঘটনা তদন্তে শিক্ষা দপ্তরও এখন নড়েচড়ে বসেছে; করা হয়েছে একটি তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করেছেন।

তবে ১৮ জুনের ঘটনার পর থেকে আর বাড়িতে থাকছেন না ওই শিক্ষক। তিনি নিরাপত্তাহীনতার ভুগছেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী।

স্বপন কুমার বিশ্বাস নামে এই শিক্ষক নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন।

সোমবার বিকালে সদর উপজেলা সিংগাশোলপুর ইউনিয়নের বড়কুলা গ্রামে ওই শিক্ষকের বাড়িতে দেখা যায়, বাড়ির সামনে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছে।

বাড়িতে তার স্ত্রী, তিন সন্তান ও বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

স্বপনের স্ত্রী সোনালী দাস বলেন, “ওই দিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কলেজে যান তিনি। তারপর এখনও বাড়ি আসেনি। তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন মোবাইল ফোন থেকে যোগাযোগ করেন।”

পুলিশ সদস্যরা থাকায় নিজেরা স্বস্তি বোধ করলেও স্বপন এখনও ‘নিরাপত্তাহীনতায়’ ভূগছেন বলে জানান তিনি।

“দীর্ঘদিন বাড়িতে না আসায় আমরা খুবই চিন্তায় আছি,” বলেন তিনি।

এই শিক্ষকের চাচাত ভাই সুমিত্র বিশ্বাস বলেন, “ওই দিন কলেজের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর থেকে আমার ভাই এখনও বাড়ি আসেনি।”

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৭ জুন ওই কলেজের ওই ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত এক বক্তব্য নিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।

এনিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন পুলিশে খবর দেন। এর মধ্যে ‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদেরও সংঘর্ষ বাঁধে।

পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর এই ছবি ছড়িয়েছে ফেইসবুকে।

ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেইসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।

তখন পুলিশ ওই ছাত্রের সঙ্গে অধ্যক্ষকেও থানায় নিয়ে যায়। তবে অধ্যক্ষকে আটক করা হয়নি বলে জানান নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “কলেজ অধ্যক্ষ কোনো ধর্ম অবমাননা করেননি। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথাও ঠিক নয়। সেদিন তাকে সেইফ করা হয়েছিল। যেহেতু তিনি অপরাধ করেননি, তার বিরুদ্ধে মামলা করারও বিষয় নেই।”

তবে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে জুতার মালা পরানো নিয়ে কর্মকর্তাদের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে শিক্ষককে হেনস্তা করার এই ঘটনা নিয়ে সোশাল মিডিয়ার সরব হন অনেকে, সোমবার ঢাকার শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশও হয়।

এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন উইংয়ের পরিচালক শাহেদুল খবির চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখতে স্থানীয় শিক্ষা বিভাগকে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা সোমবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন বলে জানান কমিটির সদস্য ও নড়াইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের এই কমিটিতে সদর থানার ওসি শওকত কবিরও রয়েছেন। কমিটিকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অচিন চক্রবর্ত্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দিনের ঘটনার পর থেকে কলেজ বন্ধ রয়েছে। তবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বলছেন, আগামীতে কলেজে কয়েকটি পদে নিয়োগ হতে যাচ্ছে। সেই কারণে অধ্যক্ষকে ঘায়েল করতে সেদিনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।

এদিকে যে শিক্ষার্থীর ফেইসবুক পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত, তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সেই ছাত্র এখন কারাগারে বলে জানান সদর থানার ওসি শওকত কবির।