‘পদ্মার সঙ্গে ৩০ বছরের যুদ্ধ শেষ’

পদ্মা সেতু চালুর দুদিনের মাথায় কমতে কমতে যাত্রী-শূন্য হতে বসেছে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ফেরি ঘাট। বেকার হতে বসেছেন এই নৌ-পথের লঞ্চ, স্পিডবোটের চালক এবং ঘাটকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা মানুষেরা।

মাদারীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2022, 01:20 PM
Updated : 27 June 2022, 01:59 PM

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর রোববার ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য তা খুলে দেওয়া হয়। এর প্রভাব পড়েছে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট ঘাটে।

সরজমিনে রোববার দেখা গেছে, প্রায় তিন দশক ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে যাতায়াতে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটটি এখন নীরব। যাত্রীদের ভিড়, নৌ-যান শ্রমিক, হকার বা খাবার হোটেলের শ্রমিকদের ডাকাডাকি কিছুই নেই। 

বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌ-পথটি অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ঘাট সংশ্লিষ্টরা।

এ নৌ-পথের লঞ্চের চালক আনোয়ার হোসেন আফসোস করে বলছিলেন, “এই পদ্মা নদীর সঙ্গে ৩০ বছর ধরে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলাম। এখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বেকার জীবন নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকব। বুঝতে পারছি না।“

৩ নম্বর লঞ্চ ঘাটের গলিতে গিয়ে দেখা গেল, কেবলমাত্র একটা ভাতের এবং চায়ের দোকান খোলা, বাকিগুলোতে ঝাঁপ ফেলা।

একটু এগিয়ে লঞ্চ ঘাটের পন্টুন ঘিরে সারি সারি বাঁধা প্রায় ৪০টি লঞ্চ। শুধুমাত্র একটি লঞ্চে কিছু যাত্রী উঠছেন পদ্মা পারাপারের জন্য। শ্রমিকদের মধ্যেও কোনো ব্যস্ততার ছাপ নেই বরং তাদের মুখ মলিন।

শিবচরের মাদবরচরের বাসিন্দা ইউসুফ মোড়ল জানান, তিনি শেষবারের মতো লঞ্চে চড়ছেন।

“সেতু চালু হয়েছে। তবে আজ শেষবারের মতো লঞ্চে যাওয়ার জন্য এসেছি। এরপর থেকে আর লঞ্চে আসা হবে না।“

আরেক যাত্রী মুক্তা খানম বলেন, তিনি বাধ্য হয়েই লঞ্চে উঠছেন।

“আমি গুলিস্তান থেকে এসেছি। গুলিস্তানে বাসে উঠিয়ে গেইটলক করে দিয়েছে। সরাসরি শিমুলিয়া ঘাটে বাস এসে যাওয়ায় লঞ্চেই পার হতে হলো। তবে, আগামীতে আর লঞ্চে আসব না।“

এই নৌ-পথের হাজী শরীয়তউল্লাহ লঞ্চের মাস্টার হানিফ হাওলাদার জানান, সারাদিন এই রুটের বাংলাবাজার ঘাট থেকে মাত্র ১০-১২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে।

“আগে ১৫ মিনিটেই একটি লঞ্চ যাত্রীতে ভরে যেত। আজ সেখানে দুই ঘণ্টাতেও ১০০ যাত্রী হয় না। আজ তবুও তো কিছু যাত্রী হয়েছে।“

এমন পরিস্থিতিতে সংসার চালাবেন কীভাবে- সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন এমভি শুভ অ্যান্ড রোদেলা লঞ্চের কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখন বেকার হয়ে গেলাম। এখন কীভাবে সংসার চালাব, কিস্তি চালাব তা বুঝতে পারছি না।”

সরকারের কাছে পুনর্বাসনের দাবিও জানান কোনো কোনো চালক ও শ্রমিক।

এমএল শাহিন লঞ্চের মালিক সাগর হাওলাদার বলেন, “সরকারের কাছে দাবি করছি, আমাদের লঞ্চগুলোকে নতুন নতুন রুটে চালানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। যাতে আমাদের বেকার থাকতে না হয়।“

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ট্রাফিক পরিদর্শক আখতার হোসেন ঘাটের ইতিহাস জানিয়ে বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে শিবচরের এই ঘাটটি চালু হয়।

“এরপর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের এই ঘাট দিয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এই ঘাটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে। তাই এখন যাত্রীদের চাপ আর থাকবে না।“

“প্রতিদিন এই রুটে ৮৭টি লঞ্চ, ১৭টি ফেরি ও দেড় শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করত। সময়ের দাবি অনুযায়ী, এখন সব নৌ-যানই সরিয়ে ফেলা হচ্ছে”, যোগ করেন ট্রাফিক পরিদর্শক আখতার হোসেন।

বাংলাবাজার ঘাটের লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, “আমরা নতুন নৌ-পথ পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছি। সরকার আশ্বাস দিলেও এখনও কোনো অনুমতি পাইনি।“

এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় কেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। চালক-শ্রমিকদের কেউ যেন বেকার না থাকে সেজন্য করণীয় ঠিক করা হবে।

এদিকে, পদ্মা সেতু চালুর পরিপ্রেক্ষিতে শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌপথের আটটি ফেরির মধ্যে দুটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌপথের ঘাট এলাকাও অনেকটাই যানবাহন শূন্য ও কোলাহলমুক্ত হয়ে যায়। যানবাহনের অভাবে রোববার ঘাট থেকে কোনো ফেরি ছাড়েনি বলে জানায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।