‘পানি থমকে এক জায়গায়, আশ্রয়কেন্দ্রে আর কত’

বৃষ্টি না হওয়া ও নতুন করে উজানের ঢল না আসায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে; তবে দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, খাবারের সংকটে ভুগছেন বানভাসি মানুষ।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2022, 07:57 AM
Updated : 27 June 2022, 08:20 AM

সুরমা নদীর পানি রোববার পর্যন্ত সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার উপরে; এবং তা কমছে ধীর গতিতে।

ওসামানীনগর, দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও বালাগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উন্নতি হয়েছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ জানান, রোববার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার উপরে থাকলেও ২৪ ঘণ্টায় পানি কমেছে ১২ সেন্টিমিটার।

“এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানিও কিছুটা কমেছে। তবে কুশিয়ারা অববাহিকায় পানি ধীর গতিতে নামছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি বলা যাচ্ছে না।“

এদিকে সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে।

সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গত ১৫ জুন থেকে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। দুদিন পর থেকে তা ভয়ংকর রূপ নেয়। শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় জেলার ১৩ উপজেলা ও মহানগরীর একাংশ কবলিত হয়। এখন নগরীর বেশিরভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে গেছে।

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আশিক উদ্দিন বলেন, “পানি এক জায়াগায় থমকে আছে। বাড়ছেও না, কমছেও না। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঘরের ভেতর পানি। এভাবে আর কতদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা যায়?”

ওসমানীনগর উপজেলার বল্লবপুর গ্রামের আব্দুল আজিম বলেন, “কুশিয়ারার পানি বাড়ায় পুরো এলাকা বন্যায় প্লাবিত। পানি সহজে কমছে না, খাবার মিলছে না। জীবন অসহায় হয়ে পড়েছে।”

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজং বলেন, “পানি ধীর গতিতে কমছে। পানি দ্রুত না কমায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। পুরোপুরি পানি না নামায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনেও উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না।”

বালাগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী রিপন আহমদ বলেন, “বন্যার শুরুর দিকে এখানে পানি ছিল না, কিন্তু এখন পানি বাড়ছে। বাজারে পানি ঢুকে অনেক দোকান তলিয়ে গেছে।”

বানভাসিদের পাশে মানুষ

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারা দেশের মানুষ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে এখানে। এই কাজে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনী।

বিপুল ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মানুষের হাহাকার কমছে না। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, নগরীর কাছের ও ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা যেসব উপজেলায় আছে সেসব স্থানে ত্রাণ বেশি যাচ্ছে। কিন্তু দুর্গম এলাকায় ওইভাবে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল এলাকার আবুল হোসেন গত এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। এর মধ্যে একদিন তিনি কিছু শুকনা খাবার পেয়েছেন কেবল।

সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের সমন্বয়হীতার কথা স্বীকার করে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবোজিৎ সিংহ জানান, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্যে প্রত্যেক উপজেলায় আলাদা আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

“প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি করার জন্য সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন এসব কমিটির কাজ তদারকি করবে।”

দেবোজিৎ সিংহ বলেন, “প্রতিটি উপজেলার প্রবেশমুখে একটি করে কন্ট্রোল রুম চালু করবে এই সমন্বয় কমিটি। তারা উপজেলায় প্রবেশ করা সবকটি ত্রাণবাহী গাড়ি আটকে বিতরণের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণ করে দেবে। প্রয়োজনে জলযান ও স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে ত্রাণ বিতরণকারীদের সহায়তা করবে এ কমিটি।”

সিলেট জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান জানান, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির যেন কোনো শেষ নেই। ঘরবাড়ি, ফসল, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি।

তিনি বলেন, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চার লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন বন্যায়। ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকার জন্য এখন অবধি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে এক হাজার ৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ এক কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।