রোববার পদ্মা সেতু চালু হওয়ার দিন সেতু পার হওয়ার টোল পরিশোধের রশিদ দেখিয়ে আবেগাপ্লুত কথাগুলো বলছিলেন গোপালগঞ্জ থেকে আসা মো. ইকবাল।
গোপালগঞ্জের মোর্শেদপুরের ইকবাল বলেন, “আমরা দীর্ঘ ৫/৬ বছর ধরে এই সেতুতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করেছি। আমরা খুব মন দিয়ে দেখতাম সেতুর কাজ কতুটুকু এগুলো। আর কত বাকি। কবে এই সেতুতে উঠব। একটা একটা দিন আমরা গুনেছি। এই আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না।”
উদ্বোধনের দিন উচ্ছ্বসিত মানুষ আর যানবাহনের চালকরা দিনভর যেন উৎসব করেছেন পদ্মা সেতুতে। শনিবার রাত থেকেই পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা ঘিরে উৎসব চলছিল। রোববার সকালে চালু হওয়ার পর টোল প্লাজার মুখে তৈরি হয় যাত্রী ও যানবাহনের লম্বা লাইন। ট্রাক-বাস ও প্রাইভেটকারের লাইনের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মোটরসাইকেলও পার হয় সেতু। মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজা ঘিরে যানবাহনের লম্বা লাইন থাকলেও কারো মুখে যেন বিরক্তি নেই। স্বপ্নজয়ের সেতুতে করে প্রথম দিনই পদ্মা পার হতে ব্যাকুল তারা।
দক্ষিণের জেলা মাদারীপুরের টেকেরহাটের ফয়সাল স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তারা ছয় বন্ধু মিলে তিনটি মোটরসাইকেলে এসেছেন প্রথম দিন পদ্মা সেতুতে উঠতে। ওপার থেকে এসেছেন মাওয়া প্রান্তে। তার ইচ্ছে ছিল পদ্মা সেতুর প্রথম টোলটা দেবেন। সে আশায় রাত ২টা থেকে টোল প্লাজার সামনে বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা। কিন্তু প্রথম টোলটি দিতে পারেনি ফয়সাল। তবে দ্বিতীয় টোলটি দিয়েছেন তিনি। প্রথম টোল দিতে না পারায় কিছুটা মন খারাপ হলেও দ্বিতীয়জন হিসেবে টোল দিতে পেরে খুশি।
ফয়সাল বলেন, “আমি নিজেকে লাকি মনে করছি; অনেক লোকের ভিড়ে দ্বিতীয় টোলটি আমি দিতে পেরেছি। সেই সাথে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছি। আমার কেমন ভালো লাগছে আমি বলতে পারছি না। পদ্মা সেতুতে প্রথম ওঠার জন্য আমি রাত ২টা থেকে টোলঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। আমার মত অনেকেই ছিল।”
মাদারীপুর থেকে আরেক শিক্ষার্থী শফিক এসেছেন স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আমরা টোল দিয়ে এপারে এসে আবার টোল দিয়ে মাদারীপুর চলে যাচ্ছি। আমরা আবার বিকালে আসব। কী যে ভালো লাগছে। এই সেতুর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। মাত্র ৫/৬ মিনিটে আমরা পদ্মা পার হয়ে চলে আসলাম। এই আনন্দ বলার না।”
“গত বছর ঈদে আমি ১৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করে পদ্মা পাড়ি দিয়েছি। এটা আমাদের নিয়মিত কষ্ট ছিল। চাইলেও আমরা বাড়ি যেতে পারিনি। প্রয়োজনেও যেতে পারিনি। এত বছর পর আমাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। আমি এখন খুব দ্রুত মাকে দেখতে বাড়ি যেতে পারব।”
সাতক্ষীরা থেকে আসা বাবুল বলেন, “আমি কাল থেকে অপেক্ষা করছি ব্রিজে ওঠার। কালকে অনেকে উঠলেও আমি পারি নাই। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি রাত ১টা থেকে অপেক্ষা করেছি। তারপরও আমার উঠতে দেরি হয়েছে।”
ঢাকা থেকে একই পোশাকে ছয় বন্ধু সুমন, সবুজ, রাফি, শাহেদ, তসিব ও কায়েস আসেন পদ্মা সেতুতে। তারা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণাঞ্চলে কখনও যাননি; তাদের কোনো স্বজনও নেই পদ্মার দক্ষিণে। তারপরও এই সেতু তাদের এখানে টেনে নিয়ে আসে।
সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সেতু বাঙালির। সকল বাংলাদেশির। এখানে কে কোন অঞ্চলের বাসিন্দা সেটা জরুরি নয়। এই সেতুর সুফল আমরা সবাই ভোগ করব। এটা আমাদের অহংকারের সেতু।”
প্রধানমন্ত্রী এই সেতু করে অনেক কিছু শিখিয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জ নিতে শিখিয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিয়েছেন, অর্জন করতে শিখিয়েছেন। এই সেতু আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”
কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রথম দিনের কারণে কিছুটা চ্যালেঞ্জ। তবে আধুনিক প্রক্রিয়ার অটোমেটিক ট্রানজ্যাকশন চালু করলে চাপ বেশি থাকলেও লাইন লম্বা হবে না।
সেতু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “পদ্মা আমাদের স্বপ্নের সেতু। এদেশের গর্বের সেতু। সকাল ৬টায় গাড়ি চলাচল শুরু করার কথা থাকলেও আমরা কিন্তু এর আগে শুরু করেছি। মানুষ এবং যানবাহন রাত থেকেই ভিড় করছে। মাওয়া প্রান্তে ভোর পৌনে ৬টায় এবং জাজিরা প্রান্তে ৫টা ৪০ মিনিটে সেতু সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।”
সকাল থেকে গাড়ির অনেক চাপ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা স্বাভাবিকতা না। আজকে অনেকেই সেতু পার হতে এসেছে প্রথম দিনের সাক্ষী হতে। আমরা দেখেছি অনেকে সারারাত রাস্তায় ছিল ভোরে পদ্মা সেতু পার হবে বলে। সবাই উসখুস করছিল কখন পার হবে।
“আমাদের এখানে ৫টি লেনে টোল নেওয়া হচ্ছে। সরকারের নির্ধারিত হারে এই টোল নেওয়া হচ্ছে এবং কম্পিউটারে রিসিট দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, সেতু সংশ্লিষ্ট সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন।
পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় ৬টি লেনের মধ্য একটি করে লেনে অটোমেটিক ট্রানজ্যাকশন সিস্টেম রাখা হয়েছে। তবে এখনো তা চালু হয়নি। পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার ৬টি লেনের মধ্য ৫টি লেনে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১২০টি যান টোল পরিশোধ করে সেতু উঠছে।
বিধিনিষেধে শিথিলতা
পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব রক্ষায় কিছু বিধিনিষেধ ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু রোববার সকাল থেকে মানুষের মধ্যে তা অমান্য করতে দেখা গেছে।
পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়ার সময় গাড়ি থামানো যাবে না; যানবাহন থেকে নামা যাবে না; সেতুতে ছবি তোলা যাবে না – এমন নির্দেশনা থাকার পরও প্রথমদিন অনেকেই সেই নির্দেশনা মানেননি। এ যেন নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা।
তবে নিয়ম ভাঙা থেকে বিরত রাখতে হাইওয়ে ও সেতুর টহল দলের চেষ্টাও কম ছিল না বলে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য।
গণপরিবহন ছাড়া অন্য প্রায় সব গাড়িকে সেতুতে গাড়ি থামাতে দেখা গেছে। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি ছবি তুলেছেন। মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ভাড়া করে পরিবার নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে আসেন কেউ কেউ।
সেনাসদস্যরা টহল গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করার পরও নিয়ম ভাঙা ঠেকাতে পারেননি। তারা সেতুর উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন টহল গাড়ি নিয়ে। থেমে থাকা গাড়ি বা মানুষকে দাঁড়াতে দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন পেট্রল ম্যান। কখনও অনুরোধ, আবার কখনও রাগ করে তাদের সরিয়েছেন।
সেতুর পেট্রল ম্যানের দায়িত্বে থাকা সাদ্দাম হোসেন বলেন, “আমি গাড়ি নিয়ে মানুষকে তাড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেউ কথা শুনতে চায় না। এমন না যে তারা একটা ছবি তুলে সরে যাচ্ছেন। তারা দীর্ঘ সময় সেতুতে অবস্থান করতে চাইছেন। এক জায়গার মানুষকে তাড়িয়ে অন্য জায়গায় যাচ্ছি। ফিরে এসে দেখি একই অবস্থা।”.