‘সেতু চালু হলে সবখানে ঘাট মরে যায়, কিন্তু এখানে উল্টো চিত্র দেখা যাবে’ মনে করছে ইলিশ রেস্তোরাঁর মালিক-শ্রমিকরা।
শুধু আসা-যাওয়ার পথে নয়, টাটকা ইলিশের স্বাদ নিতে ঘাটে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। পদ্মা সেতু ঘিরে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকার কারণেও শিমুলিয়ায় পদ্মা তীরের রোস্তারাঁয় ইলিশের চাহিদা বাড়ছে অনেক দিন ধরে।
তাই শুধু ইলিশেরই অর্ধশত রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে শিমুলিয়া ঘাটে।
‘রূপসী বাংলা’, ‘রূপালি ইলিশ’, ‘শখের হাঁড়ি’, ‘কুটুমবাড়ি’, ‘শখের ইলিশ’, ‘ইলিশ আড্ডা’ ‘ইলিশ ভোজ’সহ আরও নানা রকম বাহারি নামের এসব রেস্তোরাঁ খোলা থাকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা।
শিমুলিয়ার ইলিশ রেস্তোরাঁ মালিকদের সংগঠন ‘ইলিশ রেস্তোরাঁ হাটের’ সভাপতি মুরাদ খান বলেন, “সেতু চালু হলে ঘাটে লাখো লোক আসবেন, যাদের অধিকাংশই ইলিশের স্বাদ নিয়ে ফিরবেন।
“সেতু চালু হলে সবখানে ঘাট মরে যায়। আর এখানে হবে উল্টো চিত্র। ঘাট আরও সরব হবে। আর একটা দিন অপেক্ষা করেই তা নিজের চোখে দেখতে পারবেন।“
সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর ফেরি কমে গেলেও ঘাটের হোটেল-রোস্তোরাঁ ব্যবসা আরও বাড়বে বলে মনে করে মুরাদ খান।
তিনি বলেন, “কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আকর্ষণীয় অনেক রেস্তোরাঁ করা হচ্ছে, যার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।”
শিমুলিয়ার ইলিশ রেস্তোরাঁর সামনে ইলিশ মাছের টুকরো সাজানো থাকে। সঙ্গে ভাত, ভর্তা, ভাজিসহ অন্যান্য খাবার নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কর্মচারীরা। ক্রেতা মাছ দেখে অর্ডার করার পর টেবিলে ইলিশ ভাজা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না।
সহজে নজর কাড়ে শিমুলিয়ার ইলিশ আকৃতির ‘হিলশা প্রজেক্ট’ নামের রেস্তোরাঁ। এখানকার কর্মচারীরা মনে করছেন, আগামীতে ব্যবসা পড়তির দিকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তাদের ক্রেতা মূলত হবেন সেতু দর্শনার্থীরা, পদ্মা পারাপারের যাত্রীরা নন।
শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিডবোট ও ছয়টি ফেরি চলছে। এসব নৌযানে পদ্মা পার হন প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী। তাদের কাছে দিনভর ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি, বাদাম, ছোলা, আচার, সেদ্ধ ডিম, শিঙ্গাড়া, নারকেল চিঁড়া, শশা, দই, চকলেট, বিড়ি-সিগারেট ও প্রয়োজনীয় নানা পণ্য বিক্রি করেন অন্তত ৩০০ হকার।
ঘাটের পন্টুন ছাড়াও প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চারজন হকার ওঠেন।
শিমুলিয়া ঘাটের বাদাম বিক্রেতা ১৪ বছরের এক কিশোর বলে, “সেতু চালু হওয়ার খবর আনন্দের। সেতু চালু হলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। অন্য কাজে চলে যাব ভাবছি।“
লঞ্চে সাত বছর ধরে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করেন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সুরুজ মিয়।
তিনি বলেন, “ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে ডিম বিক্রিও বন্ধ হয়ে যাবে।“
ঝালমুড়ি বিক্রেতা হোসেন আলীর ভাষ্য, “অন্য কাজও শিখি নাই, ব্যবসা করতে হলে টাকার দরকার। তাই হকারদের তালিকা করে সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিলে নতুন কিছু করতে পারব।“
হকার সবির শেখ জানান, সেতু চালু হলে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার শঙ্কা থেকে তিনি অনেক আগে থেকেই পেশা বদলের কথা ভাবছিলেন।
সবির বলেন, অনেকে ‘হকারি’ ছেড়ে বাড়ির সামনে চা, পান-সিগারেটের দোকান দেওয়ার কথা ভাবেছেন। কেউ ভাবছেন অটোরিকশা চালানোর কথা। আবার অনেকেই গ্রামের বাড়ি ফিরে চাষবাস করবেন বলে ঠিক করেছেন।
তিনি আরও জানান, যারা অল্প বয়স থেকে ঘাটে হকারি করছেন তাদের অনেকেই আর কোনো কাজ জানেন না বলে আগামীর পেশা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। এছাড়া শহরমুখী হয়ে পোশাক কারখানা বা অন্য কাজ খুঁজবেন বলেও ভাবছেন অনেকে।
১৯৮৭ সালে মাওয়া-মাঝিরকান্দি ও চরজানাজাত নৌপথে ফেরি চালু হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু হলে মাওয়া থেকে শিমুলিয়ায় ঘাট সরিয়ে আনা হয় ২০১৪ সালে। এরপর শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও মাঝিরকান্দি ঘাটে লঞ্চ, ফেরি স্পিডবোট চলাচল করছে। ওই সময় থেকে প্রতিদিন এই দুটি ফেরিঘাট দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ চলাচল করে। বর্তমানে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ছয়টি ফেরি চলছে।
শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন করবেন। রোববার থেকে সেতু খুলে দেওয়া হবে সবার জন্য। সেদিন থেকে এ পথে বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া আর কোনো নৌযান চলবে না।
পুরনো খবর: