ভোমরা স্থলবন্দর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা সড়ক পথে মাত্র ৭০ কিলোমিটার। ফলে এ পথ দিয়ে প্রতিদিনই প্রচুর যাত্রী প্রতিবেশী দেশটিতে যাতায়াত করেন। আর প্রতিদিন প্রায় ৪০০ ট্রাকে করে আসে আমদানি পণ্য। পদ্মা সেতুর কারণে এ পথ এখন অনেক বেশি জনপ্রিয় ও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোমরার বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের খোজাডাঙ্গা স্থলবন্দর হয়ে আসা পণ্য সাধারণত এতদিন সাতক্ষীরা-যশোর-মাগুরা-ফরিদপুর-রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া হয়ে রাজধানীতে আসত। রোববার থেকে আমদানি পণ্যবাহী গাড়িগুলো ভোমরা স্থলবন্দর থেকে সাতক্ষীরা-খুলনা-গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে রাজধানীর বাদামতলি পৌঁছে যাবে। এতে আগের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু হওয়ায় সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার দূরত্ব এখন কমে গেছে। ২৬৫ কিলোমিটার থেকে ৮০ কিলোমিটার কমে গেছে। এখন পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে হবে। তাছাড়া ফেরি পারাপারের মতো বাড়তি বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হবে না। পদ্মা সেতু দিয়ে খুব কম সময়ে ভোমরা থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা সহজ হবে।”
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এজাজ আহমেদ স্বপন বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আগে এই পথ পাড়ি দিতে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। এখন পদ্মা পার হতে লাগবে পাঁচ মিনিট। আর গোটা পথ পারি দিতে পাঁচ ঘণ্টা লাগার কথা। এখন এ পথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে গতি ফিরবে। এতে ব্যবসায়ী, ক্রেতা এমনকি সরকারও লাভবান হবে।”
তবে এই সুযোগের পথে ঘোজাডাঙা বন্দরে বাংলাদেশমুখি আমদানি পণ্যবাহী গাড়ির সিরিয়াল পাওয়াকে ‘বাধা’ হিসেবে দেখছেন ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক নির্বাহী সদস্য রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী।
“সিরিয়াল পেতে যারা হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে পারছেন তারা সামান্য সময়ে ভারতীয় ছাড়পত্র পাচ্ছেন। আর যারা এই অবৈধ টাকা দিতে সম্মত হচ্ছেন না তাদেরকে ঘোজাডাঙা বন্দরে এক মাসেরও বেশি সময় বসিয়ে রাখা হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়টি সমাধান হওয়া উচিত।“
এই পথ দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতকারী পাসপোর্টধারী যাত্রীরাও সুবিধা পাবেন। সাতক্ষীরা থেকে প্রতিদিন দুই শতাধিক যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় যাতায়াত করে থাকে। বিশেষ করে সড়কপথে ভারতে জরুরি রোগী পরিবহনে একটি যুগান্তকারী সুযোগও আসবে বলে মনে করেন পর্যটন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আকবর হোসেন রাজু।
তিনি বলেন, “সাতক্ষীরা জেলার ব্র্যান্ডিং শ্লোগান ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন’। বাংলাদেশে একমাত্র সাতক্ষীরা জেলা যেখান থেকে সড়ক পথ ধরে সুন্দরবনে যাওয়া যায়। কিন্তু পদ্মা পাড়ের অসহ্য জ্যামের কারণে কেউ আসতে চাইত না। সেই বাধা পর্যটন খাতের বুক থেকে নেমে যাচ্ছে।”
পদ্মা সেতু চালুর ফলে সড়ক পথে দূরত্ব কমায় খুশি পশ্চিমবঙ্গবাসীও।
‘পদ্মা সেতু আর সাতক্ষীরা’ দুই বাংলার রাজধানীকে এক করে দেবে বলে মনে করেন ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী, পেঁয়াজ আমদানিকারক সুকুমার দাশ বাচ্চু। তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। শ্বশুর সঞ্জিত কুমার ভুট্টো খোজাডাঙ্গা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী। দুজনের মধ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগও রয়েছে।
বাচ্চু বলেন, “ঘাটে বসে থাকতে থাকতে কাঁচা পণ্য নষ্ট হওয়ার কতশত অভিজ্ঞতা আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। পদ্মা সেতু সেই ক্ষতি থেকে ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর একটি মাইলফলক।”
তিনি আরও বলেন, “দুই বাংলা তো এক সময় এক ছিল। দেশ পৃথক হয়েছে, আত্মীয়তা তো আর পৃথক হয় না। ওপারের আত্মীয়রা সেতু উদ্বোধনের আগে থেকেই বায়না ধরেছে বাংলাদেশে আসবে। সাতক্ষীরা দিয়ে এখন তাদের যাতায়াত সহজ হবে।”
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, “পদ্মা সেতুর সব থেকে বড় উপকারভোগী সাতক্ষীরা। এই সেতু জেলার পর্যটন, ব্যবসা, শিক্ষা প্রায় সবকিছুকে পাল্টে দেবে। সাতক্ষীরা থেকে সুন্দরবন সরাসরি রাস্তা, সাতক্ষীরা থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা মাত্র ৭০ কিলোমিটার।”
“কিন্তু পদ্মা ঘাটের অস্বাভাবিক কষ্টের কথা বিবেচনায় পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা ভিন্ন দিকে যেত। সেই প্রতিবন্ধকতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতায় দূর হয়ে গেল। ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যটনের বিরাট দরজা খুলে যাবে এখন সব মানুষের জন্য।”