পদ্মা সেতু বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ‘কমাবে’

পদ্মা সেতু চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে বলে আশা প্রকাশ করছেন বাগেরহাটের মৎস্য ও নানা কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীরা।  

অলীপ ঘটক বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2022, 12:56 PM
Updated : 23 June 2022, 06:32 AM

তারা নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকাসহ সারাদেশে মাছ এবং কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করে অধিক লাভ করতে পারবেন বলে আশা দেখছেন।

বাগদা, গলদা চিংড়ি ছাড়াও মাছ চাষের প্রসিদ্ধ জেলা বাগেরহাট। এসব মাছের চাহিদা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে দেশের বাইরেও রয়েছে।  

এ ছাড়া এ জেলা থেকে শসা, করলা, ঝিঙা, পেঁপে এবং মিষ্টি কুমড়াও ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে যায়।

মাছ চাষি এবং ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হিমায়িত পণ্য রপ্তানিকারকরা (বিএফএফএ) নানা কারণ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা ‘কম’ উল্লেখ করে স্থানীয় বাজারে দাম কমিয়ে দেন। মাছ চাষিদের আশা পদ্মা সেতু চালু হলে চিংড়ি ও সাদা মাছ ঢাকার বাজারে ‘সরাসরি’ বিক্রি করা যাবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান বলেন, সেতু চালুর পরে কৃষকদের গ্রুপ করে তাদের উৎপাদিত সবজি ‘সরাসরি’ বাণিজ্যিকভিত্তিতে বিক্রির উদ্যোগ নিতে কৃষি বিভাগ কাজ করবে।

দেড় দশক ধরে বাগদা, গলদা ও কার্প জাতের মাছ চাষ করছেন বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামের কবির হোসেন।

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম কমার কারণ চাষিরা জানতে পারেন না। ডিপো মালিকরা যা আমাদের বলেন আমরা তাই মেনে নিয়ে বসে থাকি। আমরা বর্তমানে ডিপোতে ৪৪ গ্রেডের বাগদা চিংড়ি ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। এরচেয়ে বড় বাগদা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।”

“আমাদের এই উৎপাদিত মাছের আন্তর্জাতিক বাজার ছাড়াও যে দেশের অভ্যন্তরে বড় বাজার আছে তা এবার প্রমাণিত হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার বাজারে এই চিংড়ি ও সাদা [কার্প] মাছ সরাসরি বিক্রির পরিকল্পনা করছি,” বলেন এই মাছ চাষি।

ছবি: পিএমও

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জেলার নয় উপজেলাতেই কমবেশি সবজি চাষ হয়; এর মধ্যে চিতলমারী, মোল্লাহাট, ফকিরহাট ও বাগেরহাট সদরে বেশি আবাদ হয়। বর্তমান খরিফ মৌসুমে শসা, করলা, ঝিঙা, পেঁপে ও মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছেন চাষিরা।

তিনি বলেন, জেলায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির (খরিফ ও রবি) আবাদ হয়ে হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ২০ মেট্রিক টন। বার্ষিক উৎপাদন ২ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই সবজির মধ্যে ৭০ হাজার মেট্রিক টন রাজধানীতে চলে যায় জানিয়ে কৃষিবিদ আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা থেকে আসা পাইকাররা যদি ২০ টাকা কেজি দরে করলা বা অন্য কোনো সবজি কেনেন তা ঢাকায় ৮০ টাকা দরে খুচরা বাজারে বিক্রি করেন।

“কিন্তু এখানকার কৃষকরা কিন্তু ওই হারে মূল্য পান না। সেতু চালু হলে এই সবজি কেনাবেচায়  মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে। এই জেলায় ভবিষ্যতে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে।”

যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনে কৃষকরা আগামীতে ফসলের নতুন নতুন জাতের আবাদে উৎসাহী হবে বলেও আশা রাখেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের উত্তরপাড়ার অসীম বাড়ৈ আইনের উপর পড়াশুনা করছেন, পাশাপাশি নিজের দেড় একর জমিতে বারো মাস সবজি চাষ করেন। এই জমিতে যে সবজি হয় তাতে তার মোট বিনিয়োগের অর্ধেক লাভ হয়।

অসীম বলেন, “ঢাকা থেকে আসা পাইকারদের কাছে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। মণে দাম দাঁড়াল ১২০০ টাকা। এই করলা ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। তাহলে কে বেশি লাভবান হলো?”

সবজি বিক্রিতে লোকসানের এই হিসাব তুলে ধরে তরুণ এই চাষি বলেন, তার পরিকল্পনা সেতু চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেই ঢাকায় গিয়ে সবজি বিক্রি করবেন।

তিনি বলেন, “চিতলমারী থেকে ঢাকায় পৌঁছতে সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আমি যদি আগের দিন সবজি কেটে পরদিন ভোরে ঢাকায় রওনা দেই তাহলে সেই সবজি বিক্রি করে বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতে পারব। সবজি মানুষ সব সময় টাটকা পেতে চায়। তাই পচনশীল এই সবজির জন্য সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করে দেবে আমাদের এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু।”

চিতলমারী উপজেলার অশোকনগর গ্রামের বিশ্বজিৎ বড়াল বলেন, নিজের দুই বিঘা জমিতে আবাদ করা সবজি তিনি এলাকায় যে দামে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন, ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এলাকার চাষিরা লাভের মুখ তেমন একটা দেখেন না।

তিনি বলেন, “পদ্মাসেতু চালু হলে সরাসরি ঢাকায় গিয়ে তা বিক্রির চিন্তা করছি। ভালো লাভ পেলে এই উপজেলার অধিকাংশ কৃষক ঢাকামুখী হবে।”

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) পরিচালক ও বাগেরহাট জেলা বিএফএ’র সভাপতি মো. শহীদ মেহফুজ রচা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার প্রত্যাশা এই সেতুর ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, কৃষিবান্ধব অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়ে ঘুচবে বেকারত্ব।

যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনে কৃষিতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে ফলে কর্মসংস্থানের ব্যাপকতা তৈরি হবে বলেও মনে করেন বাগেরহাট শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি শেখ লিয়াকত হোসেন লিটন।