নেত্রকোণার হাওর সংলগ্ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত খালিয়াজুরী উপজেলা; সেখানকার ফালাক মিয়া মাসখানেক আগেই গোলায় ধান তুলেছিলেন। বন্যায় তার সেই ধানের গোলা চলে গেছে তিন থেকে চার ফুট পানির নিচে।
উপজেলা সদরের পাশেই উত্তর আঁটিপাড়ার বাসিন্দা ফালাক মিয়া রোববার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার প্রায় ৮০০ মণ ধানের গোলায় এখন তিন থেকে চার ফুট পানি। বাজারের ভাড়া গুদামে রাখছিলাম। পানির নিচে যে ধান তলিয়েছে সেই ধান যে কী হয়, জানি না। বাড়িতে গরু-বাছুর-ছাগল আছে, হাঁস-মুরগি আছে। এসব নিয়ে কই যামু?”
একই গ্রামের মনির হোসেন (৪০)। তিনি বলেন, “আমার গোলায় প্রায় দুই হাজার মণ ধান। ঘরের মধ্যে তিন থেকে চার ফুট বানের পানি। ধান পানিতে ভেইজ্যা আছে। কী করতাম, কিবায় বাঁচাম।“
একই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের রিপন সরকারের গোলায় থাকা প্রায় ৫০০ মণ ধান এখন পানির নিচে। সেই সঙ্গে গবাদি পশু রাখা নিয়েও পড়েছেন সঙ্কটে।
“আমার আটটা গরু। তারারে সরানির জায়গা নাই। পানির মধ্যেই একটু উঁচু জায়গা দেইখ্যা রাখছি। চোরের ভয়ে নিজেও হেইখানে থাকি।”
গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানালেন খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের পাশের উত্তর আঁটিপাড়ার মিন্টু মিয়া, রূপনগর গ্রামের একদিল মিয়া।
মিন্টুর গরু-বাছুর মিলিয়ে ছয়টি আর একদিল মিয়ার চারটি। এর মধ্যে কোরবানির জন্য তৈরি করা পশুও আছে। গবাদিপশু রাখার পাশাপাশি গো-খাদ্যের সঙ্কটের কথা বললেন তারা।
একদিল বলেন, “খড়ের লাচিও ডুবে গেছে। সব আশা শেষ। গরুরে খাওয়াব কী? এখন ভরসা কিনে খাবার খাওয়ানো। আমার সেই সামর্থ্য নেই। গরুগুলো না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। সামনে কী করব বুঝতে পারছি না।”
মিন্টু মিয়ারও একটি বড় ষাঁড় এবারের কোরবানি ঈদে বিক্রি করার কথা। এখন সেই ষাঁড় তার জন্য গলার ফাঁস হয়ে গেছে। তিনি উঠেছেন খালিয়াজুরী মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে।
তিনি বলছিলেন, “নিজেদের ঘরই ডুবে গেছে, গরু রাখব কোথায়? নিজেদেরই খাবার নেই গরুকে কী খাওয়াব?”
একদিল মিয়া, মিন্টু মিয়ার মতো হাওরে অনেক কৃষক কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশু লালন-পালন করেছেন। প্রতিবছরই তারা এটা করেন। কৃষির পাশাপাশি এটা তাদের উপার্জনের একটি বড় মাধ্যম। এখন না পারছেন গরু বিক্রি করতে, না পারছেন রাখতে। খোলা আকাশের নিচে এখন গবাদি পশুর সঙ্গে মিলেমিশে দিন খাটাচ্ছেন হাওরবাসী। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের চিত্র প্রায় একই।
“এখন বড় নৌকাও পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসন একটা বড় নৌকা সংগ্রহ করেছে। এটা দিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে।”
ইউএনও আরও বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা রুয়াইল, মোমিনপুর, যোগীনগর, মুজিবনগর, আদাউড়া, আদিতপুর এলাকায়। ৫২টির বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ২০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
“অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ইউএনও কার্যালয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আমরা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। বানভাসিরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং সহায়-সম্পদ নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা তাদের শুকনা খাবার সরবরাহ করেছি।“
সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পাশের হাওরাঞ্চলের জেলা নেত্রকোণায় প্রতিদিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিই এর মধ্যে প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে হাওর সংলগ্ন খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দা ও মোহনগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা।
তিনি জানান, পানিবন্দি মানুষদের জন্যে ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে ৪৫ হাজার ৬২৭ পুরুষ, ৪৪ হাজার ২২০ নারী, ১৬ হাজার ৮৮ শিশু ও ৭৬৩ জন প্রতিবন্ধী আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যার্তদের জন্যে ৮৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮২টি টিম কাজ করছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, ৮৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ তিন লাখ টাকা এবং এক হাজার ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যা মোকাবেলায় বর্তমানে ৬৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ আড়াই লাখ টাকা ও এক হাজার ১৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে।
আরও পড়ুন