উজানের পানি এসে যে হাওরে জমা হয়; সেই বিস্তীর্ণ হাওরের অন্যতম জেলা নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী প্রধান নদ-নদীর পানি এরই মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
চলতি বন্যায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা সুনামগঞ্জের পাশের এ জেলায় শুক্রবার ভোর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলা বেশ কিছু জায়গা শুক্রবার ডুবে যায়। এতে কোথাও কোথাও সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
শুক্রবার জেলায় সারাদিনই থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা দুই থেকে তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। শনিবার সকাল নাগাদ নতুন করে বানের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে জেলার সদর, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলা।
“দুপুরের পর হয়তো এটা আরও বেড়েছে। তবে দুর্গাপুর পয়েন্টে সোমেশ্বরীর পানি একটু কমেছে। উপজেলা সদরে যে পানি উঠেছিল সেটি এখন নেমে গেছে।”
এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেলার মোট ছয়টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় প্রশাসন এ নাগাদ বানভাসি মানুষদের জন্যে ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শুক্রবার রাত নাগাদ ১৬ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ৪৭৩ হেক্টর জমির আউশ ও সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পরে রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। টানা বৃষ্টি ও জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি বেড়ে চলা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
এরই মধ্যে বানের পানির তোড়ে তলিয়ে দুর্গাপুরের তেলাচী গ্রামের আক্কাছ আলী (২৭) নামে এক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় এবং রেলসেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নেত্রকোণা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
গারো পাহাড়ি অঞ্চল দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার দুর্গম এলাকার বন্যা কবলিতরা শনিবার জানান, ঘরের ভিতরে পানি ঢুকে পড়ায় তাদের নিজেদের ও গৃহপালিত পশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
কলমাকান্দা উপজেলার বন্যাকবলিত বাহাদুরকান্দা গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব আয়েন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থাহনের ঘরডার মধ্যেই পানি উইঠ্যা পড়ছে। কিবায় থাহি ঘরে। বাইর অইয়া আইছি। বাইরেই আছি।”
“অহনও কেউই আমরার খবরডাও লয় নাই। কোনো মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি কেউই না। প্রশাসনের মাইনষেরে কইয়া আর লাভ কী! হেরাও আইছে না।“
বাহাদুরকান্দা গ্রামের পাশেই নেত্রকোণা-কলমাকান্দা সড়ক। এ সড়ক এখনও পুরোপুরি ডুবেনি। তবে সড়ক থেকে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই শুধু পানি। মূল পাকা সড়ক থেকে আশপাশের গ্রামের যে কাঁচা ও পাকা সড়ক গেছে তার প্রায় সবই ডুবে গেছে।
নেত্রকোণা জেলা সদর থেকে ঠাকুরাকোণা, দশধার, পাবই, গুমাই, গুতোরা হয়ে কলমাকান্দার সড়কটি বেশ কয়েক জায়গায় পানিতে তলিয়েছে। তবে এখনও এ পথে ভেঙে ভেঙে যান চলাচল করছে। অনেকে সড়কে গরু-ছাগল নিয়ে রেখেছেন। এ পথের পাশের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক স্কুলেই পানি উঠে গেছে।
বাবনী গ্রামের কৃষক জমির উদ্দিন (৫০)। বাড়ি-ঘরে পানি ঢোকায় তিনিও বাড়ি ছেড়েছেন। নেত্রকোণা-কলমাকান্দা সড়কের পাশে পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে গরু রাখতে অস্থায়ী ঘর তৈরি করছেন।
জমির উদ্দিন বলেন, “আমরা যেমন তেমন, খাই আর না খাই। অবলা প্রাণীগুলারে কী খায়ামু এইডাই অহন বড় চিন্তা। প্রশাসন যদি গোখাদ্য কিছু দিত তাইলে কিছুডা টেনশন কমতো।”
তৃতীয় দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জ-সিলেট এখন সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ভারতের মেঘালয় ও আসামে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে। মেঘালয়ের পাদদেশেই রয়েছে নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলা।
এরই মধ্যে সিলেটের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। আগেই বন্ধ করা হয়েছিল বিমান চলাচল।
নেত্রকোণার পাশের সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে শুক্রবার থেকেই। শনিবার ১১ উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎও নেই৷
বৃহস্পতিবার বিকালে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা পানিতে তলিয়ে যায়। শুক্রবার স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে নতুন করে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৩৫ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নেত্রকোণা জেলার বন্যা কবলিত ছয় উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।