বানে ভাসা সুনামগঞ্জ কার্যত বিচ্ছিন্ন, আশ্রয় খুঁজছে মানুষ

একতলা কোনো বাড়িতে পানি উঠতে বাকি নেই, বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ, সুরমা উপচানো বন্যা চরম দুর্বিপাকে ফেলেছে সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দাদের।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2022, 05:57 AM
Updated : 17 June 2022, 08:58 AM

হাজিপাড়ার বাসিন্দা সেলিম মিয়ার টিনশেড একতলা বাড়িতে পানি ঢুকেছে বৃহস্পতিবার বিকালে। বৃহস্পতিবার রাত কেটেছে অন্ধকারে, চরম আতঙ্কের মধ্যে। শেষমেষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কাছে এক আত্মীয়র দোতলা বাসায়।

সেলিম মিয়া বললেন, “আমার ৫০ বছরের জীবনে সুনামগঞ্জ শহরে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখিনি। শহরের সব এলাকা প্লাবিত। মানুষ আশ্রয় নিতে পারছে না। এখন ত্রাণের চেয়ে আশ্রয় জরুরি।”

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে নামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, “সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইতোমধ্যে সিলেটে কাজ শুরু করেছেন। সুনামগঞ্জেও দ্রুততম সময়ে কাজ শুরু করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীকেও কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন।”

ভারতের মেঘালয়-আসামে প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে বৃহস্পতিবার বিকালে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জ পৌর শহর। দুর্ঘটনা এড়াতে তখন থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে শহরের বাসিন্দাদের বৃহস্পতিবার রাত কেটেছে অন্ধকারে।

সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারা, শান্তিগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলা এখন পানিতে ভাসছে। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করছে না।

সব দোকানপাট প্লাবিত হয়ে নিত্যপণ্য ও ওষুধসহ নানা পণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে সহযোগিতা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে মানুষের জন্য। 

পৌর মেয়র নাদের বখত বলছেন, শহরের সব রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় আশ্রয় নেওয়ার জায়গাও খুব একটা নেই।

“শহর পুরোটাই ডুবে গেছে। মানুষ বাড়িঘরে আটকা পড়েছে। আমরা সাধ্যমত তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে প্রচুর নৌকা প্রয়োজন।”

এদিকে বৃহস্পতিবার থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলায়। শুক্রবারও বৃষ্টি চলবে বলে আভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস। তাতে সুনামগঞ্জের পাশাপাশি সিলেট ও নেত্রকোণা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ভারতের মেঘালয়ে সাড়ে ছয়শ মিলিমিটারের বৃষ্টিপাত হয়েছে বুধবার। তাতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আকস্মিক এই বন্যা আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে। শুধু জেলা শহর নয়, ছয়টি উপজেলা এখন পানির নিচে। মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসাসহ সহায়তায় কাজ করছে প্রশাসন। কিন্তু পরিস্থতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।”

দুর্গতদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় স্বেচ্ছসেবীরাও। কিন্তু সব রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় খুব বেশি কিছু তারাও করতে পারছেন না।

শহরের আরফিন নগর এলাকার স্বেচ্ছাসেবী সোহান বলেন, “এই মুহূর্তে উদ্ধারকাজের জন্য সেনাবাহিনী দরকার। প্রচুর নৌকারও দরকার। পানিতে অবরুদ্ধ ঘরবাড়িতে নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষ খুব কষ্টে আছে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেওয়া দরকার।”

তেঘড়িয়া এলাকার স্বেচ্ছাসেবী মো. আম্মার জানালেন, স্থানীয়ভাবে তারা এলাকার তরুণরা মিলে নৌকা নিয়ে কিছু মানুষকে উঁচু ভবনে বা স্কুলে সরিয়ে নিয়েছেন। অনেক মানুষ তাদের সাথে যোগাযোগ করছেন সাহায্যের জন্য।

“কিন্তু শহরে তো অত নৌকা নেই। গত রাতে অন্ধকারে কিছু করা সম্ভব হয়নি। এমন দুর্যোগের মধ্যে সুনামগঞ্জবাসী আগে কখনও পড়েনি। শহরে কোথাও আর শুকনো জায়গা মিলছে না।”

নতুনপাড়ার বাসিন্দা ইকবাল কাগজীর টিনশেড বাড়িতেও বৃহস্পতিবার বিকালে পানি উঠতে শুরু করে। পানি বাড়তে বাড়তে রাতে কোমর পর্যন্ত উঠে গেলে আর ঝুঁকি নেননি তিনি। পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন এক প্রতিবেশীর দোতলায়।

তিনি বললেন, “বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলে কল যায় না। বিভীষিকার মধ্যে আছি। মানুষের আশ্রয় দরকার, খাবার দরকার।”

সুনামগঞ্জ সদরের মোহনপুর গ্রামের তারিকুল আলম সেলিম জানালেন, তাদের গ্রামের সব বাড়িতে এখন পানি। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। কেউ কারো খবরও নিতে পারছে না।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পেইজে জানানো হয়েছে, বন্যার পানি ছাতক ও সুনামগঞ্জ গ্রিড উপকেন্দ্রে প্রবেশ করায় নিরাপত্তার স্বার্থে ওই উপকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সে কারণেই ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

“অব্যাহত বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেটের কুমারগাঁও উপকেন্দ্র ঝুঁকির মধ্যে আছে। যে কোনো সময় এই উপকেন্দ্রও বন্ধ করা প্রয়োজন হতে পারে।”

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০৮ সেন্টিমিটার, সিলেটে ৭০ সেন্টিমিটার এবং সুনামগঞ্জে ১২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল।

আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।

ফলে আগামী ৪৮ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে ।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে আগামী ২৪ ঘন্টায়। এই সময়ে তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে ।