‘ভোটের পর সংখ্যালঘুদের যেন টার্গেট করা না হয়’

কুমিল্লায় কোনো ধরনের গোলযোগ ছাড়াই ভোটের প্রচার শেষ হলেও শঙ্কা কাটছে না হিন্দুদের মধ্যে, কারণ তাদের মনে এখনও দগদগে ক্ষত হয়ে আছে গত বছর দুর্গাপূজার সময়ের হামলার ঘটনা।

গোলাম মর্তুজা অন্তু কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2022, 05:24 PM
Updated : 15 June 2022, 03:10 AM

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ভোটের পর সহিংসতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় এক বছর আগের বিরূপ স্মৃতি নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে বসবাসরত হিন্দুরা যে অভয় পাচ্ছেন না, তা ফুটে উঠল কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস টিটুর কথায়।

তিনি বলেন, কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা সব মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। প্রার্থীদের তারা এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে সংখ্যালঘুরা যে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে।

“নির্বাচন পরবর্তী কোনো সহিংসতায় যেন সংখ্যালঘুদের টার্গেট না করা হয়,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন অচিন্ত্য।

বুধবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত করতে যে সোয়া দুই লাখ ভোটার ভোট দেবেন, তার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

গত বছরের অক্টোবরে এই কুমিল্লা শহরেই দুর্গাপূজার সময় নানুয়া দিঘীর পাড়ে পূজামণ্ডপ ভাংচুরের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়েছিল, তা এই শহর ছাড়িয়ে দেশের অন্য কয়েকটি জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল।

তখন হামলার শিকার শহরের চকবাজার এলাকার কাপুড়িয়া পট্টির শত বছরের পুরনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দির আট মাসেও সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

কুমিল্লার কাপড়িয়াপট্টি শ্রী শ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দির গত বছর এমন আক্রান্ত হয়েছিল । ফাইল ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই হামলার স্মৃতি এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ওই হামলাকারী কারা ছিল, কাদের গ্রেপ্তার করা হল, তা আমরা এখনও জানি না। মামলার কোনো আপডেট আমাদের ইনফর্ম করা হয়নি। মন্দিরের কয়েক লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি আমরা।”

ওই হামলার প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ঘিরে কোনো শঙ্কা হিন্দুদের মধ্যে আছে কি না- প্রশ্ন করলে হারাধন চক্রবর্তী নিশচুপ হয়ে যান। তিনি শুধু বলেন, “এই প্রশ্নে আমি খুবই অ্যামবারাসড (বিব্রত)।”

তখন হামলা হয়েছিল শহরের ঠাকুরপাড়া এলাকার গাছতলা কালী মন্দির এবং আশপাশের হিন্দুদের বসতবাড়িতে।

মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল মন্দিরের উন্নয়ন কাজ চলছে। তবে হিন্দু বসতির টিনের বেড়ায় এখনও রামদার আঘাতের চিহ্নগুলো রয়েছে।

ওই এলাকার একজন কর্মজীবী নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার ভোট নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছি। গত দুর্গাপূজার সময় যে হামলা হইছে, পোলাপাইন নিয়া আমি কয়েকদিন অন্য জায়গায় আছিলাম।

“এখন একদল বলে গেছে, ভোট দিতে যাইতেই হইব। আরেকদল এখনও কিছু বলে নাই। তবে আমরা ভয় পাচ্ছি। এ নিয়ে মন্দিরে মিটিং সিটিংও হয়েছে। ভোটে এখন পর্যন্ত কোনো অঘটন হয় নাই, পরেও যেন না হয়, আমরা সেটাই চাই।”

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের দিন মঙ্গলবার শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের তল্লাশি দেখা যায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মোট ভোটারের এক-চতুর্থাংশ সংখ্যালঘুর হওয়ায় ভোটের মাঠে তাদের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই বেশি,তাই সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছে প্রার্থীদের ছুটোছুটিরও কমতি নেই।

পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য বলেন, ‘আমরা যত যাই বলি, নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের ওপর একটা চাপ আসে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেই জন্য আমরা এই নির্বাচনের আগে তালিকা করে ২৭টা ওয়ার্ডে গেছি। বিশেষ করে যেসব এলাকায় হিন্দু বসতি বেশি, সেখানে কয়েকবার করে গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, উঠান বৈঠক করেছি।

“তাদের বলেছি যে নির্বাচনের পরে কোনো অঘটন ঘটবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা না করে সবাই যেন ভোট দিতে যায়। বলেছি যে, দেশটা তো সকলেই, কাজের ভোট দিতে হবে সকলকে।”

কুমিল্লা সিটি এখন ভোটের অপেক্ষায়। প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহরের কান্দিরপাড় এলাকা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দল কুমিল্লায় এসে শহরের কয়েকটি মন্দিরে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুর, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী।

সুজিত রায় নন্দী আশাবাদী যে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে থেকে নৌকায়ই ভোট দেবেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা; তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আচরণে ভরসা না পাওয়ার কথা বলেছেন কয়েকজন হিন্দু নেতা।

এদিকে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তারা বলছেন, সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৩ হাজার ৬০৮ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিতে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলছেন, নির্বাচনে সম্পৃক্ত সবকিছুই ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ দিয়ে দেখছেন তারা।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথও বলেন, “কুমিল্লার ভোট নিরাপদ করতে ইসি তৎপর রয়েছে।”