তুলনামূলক বড় ব্যবধান রেখেই বিগত দুটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা মো. মনিরুল হক সাক্কু মনে করছেন, এবারকার পরিস্থিতি তার জন্য একটু ভিন্ন।
Published : 14 Jun 2022, 01:19 AM
তবে সব ধরনের ‘রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে’ মোকাবিলা করেই অতীতের ভোটের রেকর্ড ভেঙে জয়লাভের প্রত্যাশা করছেন সদ্য সাবেক এই নগরপিতা।
সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার আগে সাক্কু ২০০৫-২০০৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন পৌরসভার মেয়র। এরপর ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের ১৬ মে পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।
সাক্কু ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি ২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ছিলেন তিনি।
এর আগে একবার দলীয় প্রতীক ধানের শীষে এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পান সাক্কু। এবারও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। নির্বাচন কাছে চলে আসায় প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটছে তার। এর মধ্যেই শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন এই মেয়র পদপ্রার্থী।
প্রশ্ন: প্রচারের প্রায় শেষ মুহূর্তে চলে এসেছেন; এখন পর্যন্ত ভোটের মাঠের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
প্রশ্ন: নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আপনার দীর্ঘদিনের। এবার সাধারণ ভোটারদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মনিরুল হক সাক্কু: আমি ৪২ বছর ধরে রাজনীতি করি। দুই বারের সিটি মেয়র। এর আগে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র ছিলাম। গত ১৬ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গেই আছি। মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছে। আমিও মানুষকে আপন করে নিয়েছি। এবারের নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররাই আমার জন্য কাজ করছে। ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হয়রানি বা হুমকি দেওয়া হচ্ছে এমন কোনো অভিযোগ কি পেয়েছেন?
প্রশ্ন: সুষ্ঠু ভোট নিয়ে অনেক ভোটার শঙ্কা প্রকাশ করছেন। আপনার নিজের এ ব্যাপারে মতামত কী?
মনিরুল হক সাক্কু: আসলে ভোটারদের মতো আমিও বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত। বিশেষ করে এখন থেকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। নৌকার লোকজন নিজেদের কর্মীদের ভোট দিয়ে বিজয়ী হবে। তবে আমি মনে করি, ভোটাররা ভয়কে জয় করে কেন্দ্রে চলে গেলে দুর্বৃত্তরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
প্রশ্ন: ভোট সুষ্ঠু হলে ফলাফল যা-ই হোক, মেনে নিবেন কি-না?
মনিরুল হক সাক্কু: আমি রাজনীতি করি ৪২ বছর। আমার সেই মানসিকতা আছে। যদি ভোট সুষ্ঠু হয় আমি ফেল করলেও ফলাফল মেনে নেব।
প্রশ্ন: আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত বলেছেন, আপনি দুর্নীতির টাকায় স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি করেছেন। এর প্রমাণও আছে তার কাছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
মনিরুল হক সাক্কু: এসব হাস্যকর ও বানোয়াট কথা বলে কুমিল্লার মানুষকে বোকা বানানো যাবে না। কুমিল্লার ভোটাররা অনেক বেশি সচেতন। আমি তো বলেছি, কানাডায় কোথায় আমার বাড়ি সেই প্রমাণ দিতে, কই তিনি তো কোনো প্রমাণ দিতে পারলেন না। এসব অপপ্রচার করে ভোটের মাঠে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। আর আমি দেশেই থাকতে চাই। বিদেশে বাড়ি করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
প্রশ্ন: বলা হয়ে থাকে, কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতির সুফল আপনি সবসময় পান। মানে, বিগত নির্বাচনের সময় পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা আপনিও বলেছেন। এবারের আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত এমপি বাহারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তাহলে এবার কি পরিস্থিতি ভিন্ন?
প্রশ্ন: এবার তো আপনার দল (বিএনপি) থেকেই দুইজন প্রার্থী। এতে আপনার ‘দলীয় ভোট ব্যাংকে’ কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন কী?
মনিরুল হক সাক্কু: আসলে নির্বাচন আর সাংগঠনিক বিষয় এক না। কারণ ভোটের বিষয় আলাদা। ভোট দেবে জনগণ আর রাজনীতি করবে কর্মীরা। তিনি (স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার) হঠাৎ এসে প্রার্থী হয়ে গেছেন। এখন ভোট পেতে খালেদা জিয়ার নাম বিক্রি করছেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমি দুইবারের মেয়র, মানুষ আমাকে চেনে। আশা করছি, এই কারণে আমার ভোট ব্যাংকে কোনো প্রভাব পড়বে না।
প্রশ্ন: প্রথম সিটি করপোরেশনের তুলনায় দ্বিতীয় নির্বাচনে আপনার জয়ের ব্যবধান কমেছে। এবার ভোটারদের কাছে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মনিরুল হক সাক্কু: প্রথম নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ইভিএমে। আর গত নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ব্যালটে। গত নির্বাচনে ১২টার পর অনেকগুলো কেন্দ্র তারা (প্রতিপক্ষ) দখল করে নিয়েছিল। যার কারণে ভোটের ব্যবধান কমেছে। না হলে গত নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান প্রথম নির্বাচনকে ছাড়িয়ে যেত। এবার আশা করছি, ভোটের ব্যবধান অতীতকে ছাড়িয়ে যাবে। আলহামদুলিল্লাহ; ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, এটাই আপনার শেষ নির্বাচন। কিন্তু আপনার প্রতিপক্ষরা প্রচার করছেন, এটা আপনি বলেছেন নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এবং মানুষের সহানুভূতি পেতে। আসলে কেন আপনি এমন কথা বললেন?
মনিরুল হক সাক্কু: আমার বয়স হয়ে গেছে। সামনের বার হয়তো শরীর সুস্থ নাও থাকতে পারে। আর আমি বিগত দিনে বরাদ্দের কারণে নগরীর অনেক উন্নয়ন করতে পারিনি। এবার আমার শেষ সময়ে এসে সরকার থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এসব টাকার কাজ আগামী তিন বছরে বাস্তবায়ন হবে। কাজগুলো হলে নগরীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা ও যানজট দূর হবে। পাশাপাশি নগরীর চেহারাই বদলে যাবে। যেভাবেই হোক, আমি টাকাগুলো বরাদ্দ এনেছি। তাই শেষবারের মতো নির্বাচিত হয়ে কাজগুলো নিজের হাতেই করতে চাই। যেন আগামী প্রজন্ম বলতে পারে মেয়র সাক্কু এই কাজগুলো করে গেছেন।
প্রশ্ন: দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আপনি মেয়র নির্বাচন করায় বিএনপি আপনাকে বহিষ্কার করেছে, আবার কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সেটি করেনি। বরং তাদেরকে দলের কমিটিতে রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কী দলের ‘দ্বৈত-আচরণ’ বলবেন?
মনিরুল হক সাক্কু: অব্যশই এটা দলের ‘দ্বৈত-আচরণ’। আমি যেমন নির্বাচন করছি, তারাও তো নির্বাচন করছে। আমি পদত্যাগ করেছি, এরপরও বহিষ্কার করা হয়েছে আমাকে। কিন্তু তাদের অনেককে নতুন কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। যাক, দল যেটা ভালো মনে করেছে, সেটাই করেছে। আমি আর কী বলব।
প্রশ্ন: আপনার নির্বাচনী প্রচারে দলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে মানা ছিল। নেতাকর্মীরা তো সেটি মানেননি, আপনার প্রচারে অংশ নিয়েছেন। তাহলে এটা কি শুধু ‘লোক দেখানো’ যে, বিএনপি নির্বাচনে আসেনি?
প্রশ্ন: দুইবার মেয়র ছিলেন, কিন্তু সরকারে আপনার দল ছিল না। কাজের ক্ষেত্রে তা সমস্যা তৈরি করেনি?
মনিরুল হক সাক্কু: না, আমি তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। কারণ, আমি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। যখন যে বরাদ্দ এসেছে সঠিকভাবে কাজ করেছি। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করিনি।
প্রশ্ন: মেয়র হিসেবে আপনার সফলতা কোনটি বলে মনে করেন?
মনিরুল হক সাক্কু: আমি দুইবারের মেয়র। সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। সৎ সাহস আছে বলেই তৃতীয়বার মেয়র পদে দাঁড়িয়েছি। তাহলে বুঝেন, আমার মনোবল কতোটা শক্ত। আর সফলতার বিচার জনগণের কাছে। আমি কতটা সফল সেই মূল্যায়ন জনগণ ভোটের মাধ্যমে করবে। আমি আশাবাদী, জনগণ আমাকেই আবারও বেছে নেবেন।
প্রশ্ন: কোনো ক্ষেত্রে কি ব্যর্থ হয়েছেন? হলে কী কারণে?
মনিরুল হক সাক্কু: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নতুন হয়েছে। আমি প্রথম থেকেই মেয়র। আমার আগে যদি অন্য কেউ মেয়র হতো, তাহলে বলতাম কতটুকু ব্যর্থ হয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি, উন্নত নগরী গড়তে। ২০১২ থেকে ২০২২ এর ব্যবধানে নগরীর চিত্র দেখলেই মানুষ সব বুঝবে।
প্রশ্ন: ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়া জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মনিরুল হক সাক্কু: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
আর পড়ুন