ভোটের অংকে গুরুত্বপূর্ণ নারীরা চান নিরাপদ কুমিল্লা

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নারী ভোটারদের জয়ের বড় মাধ্যম হিসেবে দেখছেন প্রার্থীরা। এ কারণে প্রার্থীরা ভোট চাইতে নারী ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ছুটছেন; তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2022, 09:56 AM
Updated : 13 June 2022, 10:05 AM

রির্টানিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী জানান, কুমিল্লা নির্বাচনে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। আর নারী ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন। সেই হিসেব অনুযায়ী, পুরুষ ভোটারদের চাইতে নারী ভোটারদের সংখ্যা ৪ হাজার ২৬৬ জন বেশি।

এ ছাড়া করোনাভাইরাসের টিকা প্রদানের জন্য সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তৈরি করা এক প্রতিবেদনের বরাতে সিভিল সার্জন মীর মোবারক হোসাইন জানান, কুমিল্লা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশই প্রবাসী। এ ছাড়া চাকরির কারণে অনেক পুরুষ থাকেন জেলার বাইরে।

কুমিল্লা জেলায় সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রেই পুরুষদের তুলনায় নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ভোট কেন্দ্রগুলোতে ছিল নারীদের উপচেপড়া ভিড়। প্রবাসী ও জেলা বাইরে থাকা পুরুষরা ভোটার হলেও কেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারেন না।

ফলে সিটি করপোরেশনের প্রার্থীরা উপলব্ধি করছেন, তাদের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে নারীদের ভোটের ওপর।

হেভিওয়েট তিন মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের স্ত্রী ও স্বজনরাও যাচ্ছেন নারী ভোটারদের কাছে; বিভিন্ন বাড়িতে করছেন উঠান বৈঠক।

তবে নারী ভোটাররা বলছেন, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নয়, কুমিল্লাকে নারীবান্ধব ও নিরাপদ নগরীতে পরিণত করতে পারবেন এমন ব্যক্তিকেই ভোট দেবেন তারা। পাশাপাশি অনেক নারী ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পরবেন কি না সে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

জনপ্রতিনিধি হিসেবে এবার কাকে দেখতে চান এমন প্রশ্নের উত্তরে নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার ভোটার সুজানা আহমেদ বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুমিল্লা নগরীতে ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। রাতে প্রায়ই নারীরা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন। রাত ৮টা, ৯টার পর বাইরে যেতে ভয় পায় নারীরা। নগরীর বিভিন্ন সড়কে নারীদের ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি।

“আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমরা নিরাপদ কুমিল্লা চাই। যিনি নারীদের জন্য নিরাপদ কুমিল্লা গড়তে পারবেন, এমন ব্যক্তিকেই আমরা নির্বাচিত করতে চাই”, যোগ করেন তিনি।

আরেক ভোটার কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার বলেন, “এটাই আমার প্রথম ভোট। এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, আমার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। তাই শঙ্কায় আছি, এবার নিজের ভোটটা অন্তত নিজে দিতে পারব তো? আমরা মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত আর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কুমিল্লা চাই। এজন্য যিনি কাজ করতে পারবেন, তাকেই আমরা ভোট দেব।”

নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিপাড়ে নারীদের জন্য কোনো পাবলিক টয়লেট নেই; ফলে তাদের প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে জানিয়ে এ প্রতিকার চেয়েছেন নগরীর হাউজিং এলাকার গৃহিনী হেনা বেগম।

তিনি বলেন, “নগরীতে নারীদের চলাচলে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা নারীবান্ধব একটি আধুনিক নগরী চাই। সেখানে নারীদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে।”

নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার বাসিন্দা আয়েশা আক্তার শিশুদের জন্য খেলার মাঠ চান। তিনি বলেন, নগরীতে তেমন কোনো বিনোদনকেন্দ্রও নেই। যার কারণে শিশুরা অনেক সময় বিপদগামী হয়ে পড়ছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারবেন, এমন ব্যক্তিকে মেয়র চাই।”

নগরীর দক্ষিণ চর্থা এলাকার বাসিন্দা উম্মে সালমা বলেন, “নারীদের জন্য কর্মসংস্থানে বিগত দিনে জনপ্রতিনিধিরা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এবার প্রার্থীরা বলছেন, নারীদের জন্য বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। তবে আমার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি না, আমাদের জন্য কাজ করবেন এমন ব্যক্তিকে মেয়রের আসনে দেখতে চাই।”

চকবাজার এলাকার ফেরদৌস আক্তার বলেন, “প্রতিবছর নির্বাচন এলেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নারীদের কল্যাণে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু নির্বাচনের পর সব ভুলে যায়। আমরাও কাকে ভোট দেব, এবার আগে বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নেব।”

নারীরা সঠিক মেয়র নির্বাচনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পরবেন এমন প্রশ্নে সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনে নারী ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ভালো পরিবেশ চায়। তারা সুষ্ঠ পরিবেশ পেলে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে আমার মনে হয়।

“আর কোন প্রার্থী নারীবান্ধব কুমিল্লা নগরী গড়তে পারবেন, সেই সিদ্ধান্ত নারী ভোটারদেরই নিতে হবে। আশা করছি, নারীরা সবকিছু বিবেচনা করেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।”

গত ১০ বছর কুমিল্লায় মেয়রের চেয়ারে ছিলেন এবারের নির্বাচনে বিএনপিপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী টেবিল ঘড়ি প্রতীকের মনিরুল হক সাক্কু।

এই নির্বাচনে নারীদের জন্য প্রতিশ্রুতি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কাছে নারী ও পুরুষ সমান। কারণ তাদের সমান অধিকার রয়েছে। গত ১০ বছর চেষ্টা করেছি নারীবান্ধব নগরী গড়তে। আমি নারীদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করেছি, বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে নারীদের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। সেলাই প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছি তাদের জন্য।

“কুমিল্লার নারীরা সচেতন। আশা করছি, তারা অতীতের মতোই আমার পাশে থাকবেন।”

একই প্রশ্নে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বলেন, সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু নারীদের কল্যাণেও কোনো কাজ করেননি বিগত সময়ে। এবার নারী ভোটারদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, তিনি এখন বিশ্বনেত্রী। আমার নেত্রী শেখ হাসিনা নারীদের জন্য যেই অবদান রেখেছেন, আমার বিশ্বাস সেই অবদানের কথা ভেবে নারীরা নেত্রীর মার্কা নৌকায় ভোট দেবেন।”

বিএনপিপন্থি আরেক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, “আমি নির্বাচিত হলে ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য কাজ করব। প্রতিটি ওয়ার্ডে নারীদের জন্য একটি ওয়াইফাই জোন থাকবে। সেখান থেকে নারীরা তাদের ই-কমার্সের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। স্বাস্থ্য সেবাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কল্যাণকর নগরী গড়ব।”