কুমিল্লা সিটি: ভোটে গিয়ে বিএনপির ‘বড়রা’ বহিষ্কৃত, ছোটরা ‘পুরস্কৃত’

দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে নির্বাচন করায় দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করলেও উল্টো ফল হয়েছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে।

কুমিল্লা প্রতিনিধিআবদুর রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2022, 02:43 PM
Updated : 6 June 2022, 02:43 PM

প্রথমবারের মতো কুমিল্লা মহানগর বিএনপির যে আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে তাতে পদ পেয়েছেন আট কাউন্সিলর প্রার্থী।

বিএনপি এই সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে যাবে না- এটা জেনে মো. মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার দল থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে স্বতন্ত্রভাবে ভোটের লড়াইয়ে নামেন।

সাক্কু ছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে। আর কায়সার কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এবং কেন্দ্রের সহসাংগঠনিক সম্পাদকের পদে ছিলেন।

তাদের দুজনকেই দল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়। এরপর নেতাকর্মীদের ১৫ মে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।  

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি বেগম রাবেয়া চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, যারা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন, ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠন বিরোধী কার্যক্রম হিসাবে গণ্য করে’ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এরপরই ৩০ মে ঘোষিত কমিটিতে দেখা যায়, আট কাউন্সিলর প্রার্থীকে পদ দেওয়া ছাড়াও সাক্কু-কায়সারের নির্বাচন পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত অন্তত তিনজন নেতা পদ পেয়েছেন। এর মধ্যে আবার একজন ‘দলকে বিব্রত না করতে’ কমিটি থেকেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। 

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ৪৪ সদস্যের কমিটিতে নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. বিল্লাল হোসেন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সেলিম খান এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ আলম মজুমদারকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।

নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল মোমেন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মো. সাখাওয়াত উল্লাহ শিপন, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের হারুনুর রশিদ, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাছির উদ্দিন এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী কোহিনুর আক্তারকে সদস্য করা হয়েছে।

এ ছাড়া নিজাম উদ্দিন কায়সারের প্রচারে থাকা আতাউর রহমানকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং মনিরুল ইসলামকে সদস্য করা হয়েছে।

মনিরুল ইসলাম সাক্কুর নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়া মো. নজরুল হক ভূঁইয়াকে একই দিন ঘোষিত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

নজরুল হক ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৩০ মে আমার নাম কমিটিতে দেখতে পাই এবং পরদিনই পদত্যাগ করি। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পদত্যাগ নিয়ে স্ট্যাটাসও দিয়েছি। কারণ আমি মনিরুল হক সাক্কুর নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য। তাই দলকে বিব্রত করতে চাইনি।”

কাউন্সিলর প্রার্থীদের পদ-পদবির ব্যাপারে বিএনপির কুমিল্লা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ায় এরই মধ্যে দুই নেতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর যারা নতুন কমিটির পদ পেয়েছেন এবং পদ না পেলেও গুরুত্বপূর্ণ যারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। শিগগিরই এই কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“ 

“আমরা নির্বাচন থেকে নেতাকর্মীদের দূরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে সাক্কু-কায়সারের পক্ষে কাজ করায় পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কর্মীদেরও আমরা নির্বাচনী কাজ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করছি।”

তবে বিএনপির নির্দেশ আর মাঠের পরিস্থিতি ভিন্ন বলে জানাচ্ছেন কর্মীরাই।

নগরীর টমছম ব্রিজ এলাকার যুবদল কর্মী গোলাম সরওয়ার অকপটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কর্মীদের কোনো পদ নেই, এজন্য বহিষ্কারের হুমকিতে কেউ তোয়াক্কা করছেন না।”

২২ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর ও প্রার্থী শাহ আলম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি শুনেছি মহানগর কমিটিতে আমাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। কিন্তু আমি এখন নির্বাচনের মাঠ নিয়েই ব্যস্ত আছি। তাই এ ব্যাপারে কিছু ভাবতে পারছি না, বলতেও পারছি না।“

“আমি কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরেই রাজনীতিতে আছি। দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেই। আর এই কমিটি তো নির্বাচনের কারণে হয়নি। কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া অনেক আগে থেকেই শুরু হয়। সেখানে হয়তো আমার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। দল আমাকে আমার কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করে পদ দিয়েছে।”

এই কাউন্সিলর প্রার্থী আরও জানান, তিনি যে নির্বাচন করছেন এজন্য দলের নেতারা তাকে কোনো ধরনের সতর্ক করেননি বা নোটিশও দেননি।

নগরীর হাউজিং এলাকার বিএনপি কর্মী মো. শাহজাহান বলেন, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর বিএনপি- দুটি ধারায় বিভক্ত। একপক্ষে রয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলণা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গত দুইবারের মেয়র সাক্কু। প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রতিদিন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।

ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সার কেন্দ্রীয় নেতা আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের শ্যালক। তরুণ এই প্রার্থীর প্রচারে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের বেশ প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে।

গত ২৯ মে কুমিল্লায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের উপস্থিতিতে এক মতবিনিময় সভায় কায়সার বলেন, “আমি ভোটে লড়ার জন্য দল ছেড়েছি। এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আমার জন্য মাঠে কাজ করছেন রাজনৈতিক কর্মীরা।

“রাজনীতি করলে নেতাকর্মীদের নামে মামলা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার নামেও ১৪টি মামলা আছে। তবে ভোটের সময় আমার কোনো নেতাকর্মীকে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করা যাবে না, আপনার কাছে এই নির্দেশনা চাচ্ছি।”

কায়সার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তৃণমূলের কর্মী ও মানুষের অনুরোধে আমি ভোটের মাঠে। কর্মীরা আমার জন্য মাঠে আপ্রাণ কষ্ট করছে। যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই কর্মীদের ঢল নামছে।”

অপরদিকে সাক্কু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লা সিটিতে দুইবার মেয়র ছিলাম। ২০০৫ সাল থেকে ভোটের মাঠে অভিজ্ঞ আমি। শুধু মিছিল-শোডাউন নিয়ে গণসংযোগ করলেই বোঝা যায় না, কার কতো কর্মী আছে।”

“আর আমি নির্বাচনে নেতাদের ওপর নির্ভর করিনি। প্রতিটি নির্বাচেন তৃণমূল কর্মীরাই আমার বিজয়ের চাবিকাঠি ছিলেন।“

আরও পড়ুন: