সাক্কুকে কি ‘চ্যালেঞ্জের মুখে’ ফেললেন নিজাম

আওয়ামী লীগের সময়ে টানা দুইবার বিপুল ভোটে জিতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র হয়েছেন মো. মনিরুল হক সাক্কু। সেই দুটি নির্বাচনে তিনি ছাড়া বিএনপির আর কোনো প্রার্থী ছিল না। কিন্তু এবার সাক্কুর পাশাপাশি আরও একজন ‘বিএনপি নেতা’ মাঠে রয়েছেন।

কুমিল্লা প্রতিনিধিআবদুর রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2022, 03:48 AM
Updated : 25 May 2022, 04:14 AM

১৫ জুনের নির্বাচনে ‘বিএনপির দুই নেতা’র মেয়র পদে নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে সরগরম কুমিল্লার রাজনীতি। কে কার ‘ভোট কাটবে’ তা নিয়ে নানা হিসাব কষতে শুরু করেছেন ভোটাররা।

ভোটের মাঠে থাকা বিএনপির আরেক ‘নেতা’ হচ্ছেন নিজাম উদ্দিন কায়সার। তিনি কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির পাশাপাশি বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সাক্কু ছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যদি বিএনপি এরই মধ্যে সাক্কু ও নিজাম দুজনকেই চিরতরে দল থেকে বহিষ্কার করেছে।

নগরীর দক্ষিণ চর্থা এলাকার বিএনপির কর্মী একরাম হোসেন মঙ্গলবার রাতে বলেন, “গত দুটি নির্বাচনে সাক্কু ছাড়া বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিলেন না। যার কারণে তিনি একচেটিয়া বিএনপির সব ভোট পেয়েছেন। এবার বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে সাক্কু ও কায়সারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।”

“আর শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ইমরান মনোনয়ন প্রত্যাহার করলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের অবস্থানই ভালো থাকবে।”

রানীর দীঘি এলাকার বাসিন্দা যুবদলের কর্মী আজাদ হোসেন মঙ্গলবার রাতে বলেন, “বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে নেমে এলো। বিএনপির ভোট ভাগাভাগিতে সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে দল কখনও ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়া উপকৃত হয় না।”

নিজাম প্রার্থী হওয়ায় নিজের জন্য কোনো বিপদ দেখছেন কি-না জানতে চাইলে দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, “কায়সার আমার ছোট ভাই। সে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। সেখানে আমার বলার কী আছে?”

“সে তো কুমিল্লার ভোটার। কুমিল্লার নাগরিক সে। তার তো নির্বাচন করার অধিকার আছে। সে নির্বাচন করছে।”

অপরদিকে নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, “তৃণমূলের নেতাকর্মী ও নগরীর মানুষের অনুরোধে আমি এখন ভোটের মাঠে। আমি কাউকে ঠেকাতে প্রার্থী হয়েছি- এটা ভিত্তিহীন কথা। আমি চাই, ভোটে বিজয়ী হয়ে কুমিল্লার নির্যাতিত মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।”

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালে কুমিল্লা পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নাগরিক সমাজের ব্যানারে প্রার্থী হন সাক্কু। নির্বাচনে তিনি ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রবীণ নেতা আফজল খান পান ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট।

২০১৭ সালের ৩০ মার্চ বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হন সাক্কু। সেবার তিনি আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে ১১ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেন।

গত ১৬ মে শেষ কর্মদিবসে মেয়র কার্যালয়ে সাক্কু সাংবাদিকদের বলেন, এটাই তার ‘শেষ নির্বাচন’ এবং তিনি দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্রভাবে লড়বেন। 

১৯ মে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে প্রার্থিতা বৈধ হওয়ার পর সাক্কু এবং নিজাম দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা দিলেও রাতে তাদেরকেই দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের কথা জানায় কেন্দ্র। এরপর ২১ মে সাক্কু-নিজামের ভোটের প্রচারে অংশ না নিতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিপদে তৃণমূলের নেতাকর্মী

কুমিল্লায় বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। জেলার রাজনীতিতে সাক্কুর বিরোধী হিসেবে পরিচিত  বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক এবং দলের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক হাজী  আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। দুজনেরই আলাদা বলয় ও অনুসারী রয়েছে। মেয়র পদপ্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার হচ্ছেন হাজী ইয়াছিনের আপন শ্যালক। তিনি এবারই প্রথম নির্বাচনে মাঠে এসেছেন।   

নগরীর কান্দিপাড় এলাকার বাসিন্দা বিএনপির তৃণমূলের কর্মী আহমেদ উল্লাহ বলেন, এই বিরোধের শুরু ২০০৯ সালে। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সম্মেলনে মনিরুল হক সাক্কু শীর্ষ পদ পাননি। তার অনুসারীরাও কোনো পদ পাননি। এরপর থেকে আলাদা-আলাদা বলয়ে আছেন দুই নেতা।

বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেই বিরোধের রেশ পড়ে কুমিল্লা মহানগর কমিটি করার ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন হলেও দলীয় কোন্দলে এখনও মহানগর কমিটি গঠন করা যায়নি। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতারাই মহানগরের সব বিষয় দেখভাল করছেন।

স্থানীয় বিএনপির কর্মী মোবারক হোসেন বলেন, “কুমিল্লা সিটি মেয়রের পদটি বিএনপির। আমরা চাই, স্বতন্ত্রভাবে লড়লেও বিএনপির কেউই এই চেয়ারে বসুক। যদিও এবার নির্বাচন নিয়ে হার্ডলাইনে বিএনপির নেতারা। তারা এরই মধ্যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছেন।

“যার কারণে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা আতঙ্কে আছেন। অনেক কর্মীই দলের জন্য কাজ করেন ভালো একটি পদে যাওয়ার জন্য। এবারের নির্বাচনে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তৃণমূলের কর্মীরা কারও পক্ষে সরাসরি মাঠে কাজ করলে নিজেরাই বিপদে পড়বে।”

প্রচারে গিয়ে বিপদের আশঙ্কার কথা বলছেন কান্দিপাড়ের বিএনপি কর্মী আবদুল্লাহও।

নগরীর ছোটরা এলাকার বিএনপির কর্মী মাহাবুব আলম বলেন, “একে তো এখানে বিএনপির দুই পক্ষ। এখন নির্বাচনী মাঠেও তারা মুখোমুখি অবস্থানে। তার ওপর দলের পক্ষ থেকে যেসব বিধিনিষেধ দেওয়া হচ্ছে, তাতে দলের কর্মীরা আতঙ্কে আছেন।

“এবার ১০৫টি কেন্দ্রে ভোট হবে। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে প্রতিটি কেন্দ্রে কমিটি করা হয়। এখন বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা যদি কেন্দ্র কমিটির দায়িত্ব পালন করে, তাহলে তাদেরই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।”

এক নজরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন

• তফসিল ঘোষণা: ২৫ এপ্রিল

• মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ: ১৭ মে

• মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই: ১৯ মে

• মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ: ২৬ মে

• প্রতীক বরাদ্দ: ২৭ মে

• ভোট গ্রহণ: ১৫ জুন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ১০৫ কেন্দ্রের ৬৪০টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে

• নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন ও পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক সরওয়ার জাহান ভূঁইয়া দোলন বলেন, “বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না- এটা অনেক আগেরই ঘোষণা। এরই মধ্যে কেন্দ্র থেকে সিটি নির্বাচন নিয়ে আমাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।“

“পদ-পদবিধারী কোনো নেতা তো মাঠে নামার প্রশ্নই উঠে না। আমরা তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরও নির্দেশনা দিচ্ছি, তারা যেন নির্বাচনী মাঠে না নামেন। যারা প্রকৃত বিএনপির লোক, আশা করছি, কেউই এই সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না।” 

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) মোস্তাক মিয়া বলেন, “দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় এরই মধ্যে দুই নেতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটা থেকেই বোঝা যায় বিএনপি বিষয়টি নিয়ে কতটা হার্ডলাইনে।

“এরপরও যদি পদধারী কোনো নেতা এই দুই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আশা করছি, তৃণমূল থেকে শুরু করে শহীদ জিয়ার আর্দশের কোনো সৈনিক দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। কারণ এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কোনো আগ্রহ নেই।”

মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, “দলকে বিব্রত করতে চাইনি বলেই নিজেই পদত্যাগ করেছি। এরপরও দল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ২০১২ সালের নির্বাচনেও দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করেছি। তখন তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই ভোটারদের কাছে গিয়ে আমাকে বিজয়ী করেছে। ২০১৭ সালের ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে করায় দলের নেতারা আমার পক্ষে ছিলেন।” 

“আমি ৪২ বছর ধরে রাজনীতি করি। আমি কখনও নেতাদের ওপর নির্ভর করিনি। এ পর্যন্ত যত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি প্রতিটি নির্বাচেন তৃণমূল কর্মীরাই আমার বিজয়ের চাবিকাঠি ছিলেন। কারণ আমি তৃণমূলের সঙ্গেই আছি। তাদেরকে নিয়েই বিগত সময় মাঠে ছিলাম। আশা করছি, অতীতের মতোই এবারও তারা আমার পক্ষে মাঠে থাকবে। আমি বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।”

মেয়র পদপ্রাথী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, “যৌক্তিক কারণে দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। আমি দলের সম্মান রক্ষায় পদত্যাগ করেছি। এরপরও দল আমার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি দলের আদর্শ নিয়েই মানুষের কাছে ভোট চাইব। তৃণমূল নেতাকর্মীরাই আমার ভরসা। আশা করছি, তারা আমাকে নিরাশ করবেন না। তারা এরই মধ্যে আমাকে বিজয়ী করতে কাজ শুরু করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং আমার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হয়রানি না করা হলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবো, ইনশাআল্লাহ।”

ভোটের মাঠে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে রয়েছেন- আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মাসুদ পারভেজ খান ইমরান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাশেদুল ইসলাম এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান।

আরও পড়ুন: