অযত্নে-অবহেলায় ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন জাদুঘর

উদ্বোধনের চার বছর পরেও সদর দরজায় তালা ঝুলে সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন, সামনে-আশপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, নেই রক্ষণাবেক্ষণের ছিটেফোঁটা- কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের জন্মভিটে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হলেও সেটির হাল এখন এমনই।

হাসিবুর রহমান জাহাঙ্গীরনগরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2022, 08:43 AM
Updated : 22 May 2022, 08:44 AM

সরকারের নিয়ন্ত্রণে ২০১৬ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন জাদুঘর নির্মাণকাজ শুরু করে ঐতিহ্য অন্বেষণ নামের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র, উদ্বোধন হয় দুবছর বাদে ২০১৮ সালে।

নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা গ্রামে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জাদুঘরটির ভেতরটা দেখার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মূল দরজায় তালা।

স্থানীয়রা জানান, সপ্তাহে কেবল দুদিন শুক্র ও শনিবার এই তালা খোলা হয়; একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই জাদুঘরে থাকেন।

ওই দুই দিন কোনো দর্শনার্থী এলে তাকে জাদুঘরটি ঘুরিয়ে দেখান হয় জানিয়ে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে দর্শনার্থীরা এলেও তাদের ফিরে যেতে হয়।

কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হলেও নেই রক্ষণাবেক্ষণ

জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ এনেছেন ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই অধ্যাপক বলেন, "গিরীশ চন্দ্র সেনের জাদুঘর নিয়ে আমার অনেক কাজ করার ছিলো, এখনও আছে। সপ্তাহে দুই দিন শুক্র-শনিবার একজন লোক দিয়ে রেখেছি বিষয়টি তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই লোককে মাসে সাত হাজার টাকা দিতে হয় আমার পকেট থেকে। কর্তৃপক্ষ এখানে কিছুই করছে না।

২০১৬ সালে ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের জাদুঘর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৮ সালে

এ রকম বিষয়গুলো অবশ্যই দেখভাল করে থাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা আমরা পাইনি তাদের কাছ থেকে।"

উত্তরাধিকার না থাকায় এবং সংস্কারের অভাবে গিরিশ চন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন বাড়িটি দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন।

পরে জেলা প্রশাসন ও ঐতিহ্য অন্বেষণের মধ্যে বাড়িটি সংরক্ষণ ও জাদুঘর নির্মাণের চুক্তি হয়। এটি বাস্তবায়নে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদানও আসে ঐতিহ্য অন্বেষণের কাছ থেকে।

একাধারে সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৩৪ সালে নরসিংদীর পাঁচদোনা গ্রামে।

সরজমিনে দেখা গেছে, জাদুঘরটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়নি। মূল দরজার সামনের জমিতে কিছু জায়গা জুড়ে বালির ঢিবি। স্থানীয় কয়েকজন জানান, আশপাশের মানুষেরা তাদের বাড়ির নির্মাণ কাজের বালি এখানে রেখেছেন। আর পাশেই ময়লা জড়ো হতে হতে সেটি ভাগাড়ের চেহারা নিয়েছে।

বৃষ্টি হলে জাদুঘরে ঢোকার রাস্তাতেও পানি জমে। জাদুঘরের ভবনের কোণার অংশটি মানুষের শৌচকাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

সপ্তাহে কেবল দুদিন শুক্র ও শনিবার দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরের তালা খোলা হয়

বাড়িটির বাইরে থেকে দোতলার গ্রিলবিহীন ব্যালকনির কিছু অংশ দেখা যায়। সেখানে রাখা আছে বেশ কিছু বই। রক্ষণাবেক্ষণে কেউ না থাকলে এইগুলো নষ্ট হওয়া বা চুরির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জাদুঘরের সামনের জমির এক পাশে ময়লা জড়ো হতে হতে সেটি ভাগাড়ের চেহারা নিয়েছে

জাদুঘরের বাইরে একপাশে দেখা যাবে 'ব্রাহ্মসমাজের সদস্যগণ' শিরোনামে একটি ব্যানার। রোদে-জলে ব্যানার এমনভাবে ছিঁড়েছে যে ছবি দেখে বা নাম পড়ে কাউকে চেনার সুযোগ নেই, পড়ার উপায় নেই ব্যানারের পাশের লেখাটিও।

জাদুঘরটির সামনে ময়লার ভাগাড় সম্পর্কে ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "সপ্তাহে দুই দিন খোলা রেখে আর কী-ই বা করতে পারি আমরা! নরসিংদী জেলা কর্তৃপক্ষ যদি বিষয়টি দেখে, তদারকি করে তাহলে কে ময়লা ফেলছে বা বাজেভাবে এটাকে কে ব্যবহার করছে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।"

যত্নের অভাবে দোতলার গ্রিলবিহীন ব্যালকনিতে রাখা বইগুলো নষ্ট হচ্ছে

এসব সমস্যা শিগগিরই সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল জাকী। "করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে দীর্ঘ বন্ধের কারণে এখানে হয়তো সমস্যা হয়ে গেছে। জাদুঘরটির সমস্যা সমাধানের জন্য যা করা দরকার আমরা শিগগিরই করব।" 

ঐতিহ্য অন্বেষণ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একাধারে সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৩৪ সালে নরসিংদীর পাঁচদোনা গ্রামে।

পেশাগত জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে কাজ করতেন। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা করেন, পরবর্তীতে সাহিত্যচর্চাও করেন গিরীশ চন্দ্র সেন।

জাদুঘরের বাইরে একপাশে 'ব্রাহ্মসমাজের সদস্যগণ' শিরোনামে ব্যানারটি রোদে-জলে নষ্টের পথে

ব্রাহ্ম ধর্মপ্রচারক হিসেবে তিনি 'ভাই' খেতাবে ভূষিত হন। আরবি, ফারসি ভাষায় গবেষণা এবং পূর্ণাঙ্গ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করায় তিনি 'মৌলভি' খেতাব পান। 

পরবর্তীতে তার নিজস্ব প্রকাশনী থেকে বাংলায় অনুদিত কোরান শরীফ প্রকাশ করেন।

১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট গিরীশ চন্দ্র সেন ঢাকায় মারা যান।