মৌসুমের শুরুতেই ঘেরে ঘেরে চিংড়ির মড়ক

জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও অপুষ্ট পোনার কারণে মৌসুমের শুরুতেই ‘সাদাসোনা’ খ্যাত বাগেরহাটের বাগদা চিংড়ি ঘেরে মড়ক লাগায় চাষিরা আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছেন; খরচ তোলা নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় তারা। 

বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2022, 06:11 AM
Updated : 19 May 2022, 06:11 AM

এক মাস ধরে জেলার নয় উপজেলাতেই কমবেশি বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। তবে দুই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ ঘেরের চিংড়ির মড়কের কথা জানিয়েছে চাষি ও মৎস্য বিভাগ।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) এ এস এম রাসেল বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব উপজেলাতেই কমবেশি চিংড়ি মারা যাচ্ছে। তবে রামপালের চারটি ও মোংলার দুটি ইউনিয়নের ৯০ ভাগ ঘেরের চিংড়ি মারা গেছে।”

“বাগেরহাট জেলায় পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ঘেরের চিংড়ি মারা গেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।”

মড়কের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সম্প্রতি ঘেরের পানির তাপমাত্রা পরিমাপ করে দেখেছি, তাতে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রি রয়েছে। এটি বাগদা চিংড়ির মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই তাদের ঘেরে পানি বেশি রাখতে তিন থেকে চার ফুট গভীরতা রাখতে বলেছি।”

বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা চিংড়ির জন্য বিখ্যাত। এই খাতে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১২ থেকে ১৫ ভাগ আসে বাগেরহাট থেকে। জেলায় ৬৬ হাজার একর জমিতে মাছের ঘের রয়েছে। ঘেরের সংখ্যা ৭৩ হাজার।

রামপাল উপজেলার ফয়লা গ্রামের চাষি আদিল শেখ বলেন, “তিন বিঘার দুটি ঘেরে তিন লাখ টাকা খরচ করে মাছ ছাড়ি। এ পর্যন্ত আমি হাজার বিশেক টাকা মাছ ধরে বিক্রি করেছি। সম্প্রতি আমার ঘেরে ভাইরাস লেগে মাছ মরে গেছে। সময়মতো পানি না পাওয়া ও পানিতে অতিরিক্ত লবণ থাকার মাছ মারা গেছে। এ ছাড়া এ বছর বৃষ্টিও নেই। এ বছর আমার খরচের টাকাই উঠবে না।”

একই উপজেলার গিলাতলা গ্রামের রাখাল বিশ্বাস বলেন, “দেড় বিঘা জমিতে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে চিংড়ি চাষ করেছিলাম। আমি এখনও এক টাকার মাছও ধরতে পারিনি। হ্যাচারির খারাপ পোনা ছাড়ার কারণেই মনে হয় সব মাছ মরে গেছে। বর্তমানে হ্যাচারির পোনার মান ভাল না।”

পোনার মান ঠিক রাখতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান এই চাষি।

সদর উপজেলার কাড়াপাড়া গ্রামের নাজমুল শেখ দেড় বিঘা জমিতে ৫০ হাজার টাকার মাছ ছেড়েছিলেন। ঘেরে এখন কোনো মাছ পাচ্ছেন না।

“পানিতে অতিরিক্ত লবণ ও অনাবৃষ্টির কারণে ঘেরের মাছ মারা গেছে। ধারদেনা করে ঘেরে মাছ চাষ করেছি। এখন মাছ মারা গেলে ধারদেনা শোধ করব কিভাবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি।

তিন একর জমিতে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছিলেন কাড়াপাড়ার মোস্তফা শিকদার। এই এলাকায় ২০০ বেশি মানুষ মাছের চাষ করে। মোস্তফার ঘেরে মড়ক লেগে সব মাছ মারা গেছে। তার ধারণা, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া ও অতিরিক্ত লবণ পানির কারণে মাছ মরে যায়।

মোস্তফা বলছিলেন, “আমার একার না, এই এলাকার অধিকাংশ ঘেরের মাছ মরে গেছে। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ এই ঘেরের উপর নির্ভরশীল। ঘেরের আয় দিয়ে আমাদের চলতে হয়। ঘেরে আমরা যে হ্যাচারির বাগদার পোনা ছাড়ি তা অপুষ্ট। এই পোনার মান ভাল কী মন্দ তার উপর সরকারের কোনো নজরদারি নেই।

“হ্যাচারি মালিকরা যা বাজারে বিক্রি করছে আমরা তাই কিনে এনে ঘেরে ছাড়ছি। অপুষ্ট রোগাক্রান্ত পোনার কারণে এই মড়ক লেগে থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবেন।”

তাই পোনার বিষয়ে সরকারের উচিত হ্যাচারিগুলোর ওপর নজরদারি করা। চিংড়ি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এই চাষি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, “জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে গত এক মাস ধরে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এ কারণে ঘেরের চিংড়ি অস্বাভাবিকহারে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া চাষিদের ঘেরে নিন্মমানের পোনা ছাড়ার কারণেও মাছ মরে যাচ্ছে বলে ধারণা করছি।“

মারা যাওয়া চিংড়ি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে চিংড়ি মারা যাওয়ার সঠিক কারণ জানতে পারবে মৎস্য বিভাগ।

“চাষিদের পরামর্শ দিয়েছি, ঘেরের পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে। তারা যখন ঘেরে পোনা ছাড়বে অবশ্যই যেন তা পকেট ঘেরে পরিচর্যা করে ছাড়ে। এই পরামর্শ মেনে চললে চিংড়ির মড়ক কমে আসবে।”

তবে মড়ক লাগায় চলতি অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “কারণ এখন মাত্র চিংড়ির মৌসুম শুরু হয়েছে। আগামীতে নতুন করে পোনা ছেড়ে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন চাষিরা।”