হৃদয় মণ্ডল: বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি নির্মূল কমিটির

মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও তার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2022, 02:45 PM
Updated : 15 April 2022, 02:53 PM

শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের নাগরিক সমাজের সঙ্গে ‘মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সন্ত্রাস প্রতিহতকরণে সরকার ও নাগরিক সমাজের করনীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় নির্মূল কমিটি এ দাবি জানায়।

চলতি বছরের ২০ মার্চ হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বিজ্ঞান ক্লাস নেওয়ার সময় তার কথা অডিও রেকর্ড করে কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে রেকর্ডটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

২২ মার্চ একদল শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করে; তাদের সঙ্গে কিছু বহিরাগতও যুক্ত হয়। পরে পুলিশ গিয়ে হৃদয় মণ্ডলকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

ওই রাতেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও ধর্মী বিশ্বাসকে অপমানিত করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ২৯৫/২৯৫ক ধারায় মুন্সীগঞ্জ থানায় বিদ্যালয়টির অফিস সহকারী (ইলেক্ট্রিশিয়ান) মো. আসাদ মামলা করেন এবং হৃদয় মন্ডলকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপরই বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।

সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জ সার্কিট হাউজে এই মতবিনিময় সভায় নির্মূল কমিটির নেতারা এবং স্থানীয় গণ্যমান্যরা অংশ নেন।

সভায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রশাসন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।

“কখনো তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট জালিয়াতি করে ইসলাম অবমাননার পোস্ট দিয়ে কিংবা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে কিংবা স্কুলে হিজাব-নেকাব নিয়ে মিথ্যাচার করে সনাতন ধর্মালম্বী শিক্ষকদের হেনস্তা করে বাংলাদেশকে মোল্লা উমরদের তালেবানি

আফগানিস্তান বানাতে চাইছে।”

তিনি বলেন, “আজ আমরা মুন্সীগঞ্জ এসেছি স্কুল শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানানোর জন্য। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্ররোচনায় স্কুলের কিছু ছাত্র যেভাবে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা করেছে, ভিকটিমকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো তাকে গ্রেপ্তার করে প্রশাসন যে ন্যক্কারজনক আচরণ করেছে – আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি।

“হৃদয় মণ্ডল ১৯ দিন পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বটে, তবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, অতঃপর বছরের পর বছর আদর্শবান এই শিক্ষককে মিথ্যা অভিযোগের গ্লানিকর মামলার বোঝা বইতে হবে, যেটি ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিরীহ ছেলে রসরাজ এবং এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মামলার অন্যান্য ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে।”   

শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে সরকারের কাছে পাঁচদফা দাবি তুলে ধরেন।

দাবিগুলো হলো:

১. অবিলম্বে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া রসরাজ ও সুনামগঞ্জের ঝুমন দাসসহ সম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রমূলক সকল মামলা প্রত্যাহার করে ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওয়তায় আনা হোক। সেসঙ্গে মুন্সীগঞ্জে প্রশাসনকে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল ও তার পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনার গঠন করতে হবে।

২. সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রদান এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতকরনের জন্য অবিলম্বে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।

৩. সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য অবিলম্বে বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন করতে হবে। ৪. ওয়াজের নামে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারার অনুসারীদের প্রতি অনবরত বিষোদগার করে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জমি উর্বর করছে। অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৫. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের যেকোনো স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাম্প্রদায়িক উসকানি বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহিত করার জন্য ইতিপূর্বে চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে বদলি বা সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তি নয়।

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তার ও ১৯ দিন কারারুদ্ধ করে রাখার সমালোচনা করেন।

সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু লোক যারা তাদেরকে

সহায়তা করে চলেছে – এদেরকে অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে।

তিনি হৃদয় মন্ডলের লাঞ্ছনার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান।

১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, কেবল সরকার ও পুলিশের একার পক্ষে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিহত করা সম্ভবপর নয়; এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। নিজ নিজ এলাকার মানুষকেই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।

মুন্সীগঞ্জের পৌর মেয়র মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব বলেন, “মৌলবাদী শক্তিকে রুখতে হলে সম্মিলিতভাবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আগামী মঙ্গলবার বিনোদপুর রামকুমার স্কুলে – যেটা হৃদয় মণ্ডলের কর্মক্ষেত্র – সেখানকার মাঠে তাকে সংবর্ধন জানাব বিজ্ঞানের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের জন্য।”

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকরা যেন সকল প্রকার ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে শিক্ষা দিতে পারেন এজন্য সরকারকে কার্যকার ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ছড়িয়ে যাওয়া বিষয়ে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা রয়েছে। এ থেকে উত্তরণে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করাসহ পাঠ্যসূচিতে সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল কাজী মুকুল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের লাঞ্ছনার ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ, বিনোদপুর স্কুলের মামলাকারী ইলেকট্রিশিয়ান আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা সম্মিলিতভাবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান।

বিনোদপুর রামকুমার স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বলেন, “আজকের যারা আমার লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানাতে মুন্সীগঞ্জের সার্কিট হাউজের এই অনুষ্ঠানে এসেছেন তাদের প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এরপর আপনারা আমার পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন সেজন্য শিক্ষক হিসেবে আমি খুব গর্বিত।”

আরও পড়ুন