১৯ দিন পর জামিন পেলেন শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল

শ্রেণিকক্ষের আলোচনার সূত্র ধরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার মুন্সীগঞ্জের স্কুল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল অবশেষে জামিন পেলেন। 

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2022, 07:25 AM
Updated : 10 April 2022, 12:17 PM

মুন্সীগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক অতিরিক্ত জেলা জজ মোতাহারাত আখতার ভূইয়া রোববার তার জামিন মঞ্জুর করেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সিরাজ ইসলাম পল্টু। হৃদয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহীন মোহাম্মদ আমানুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন।

হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক। ২১ বছর ধরে তিনি ওই স্কুলে বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন।

গত ২০ মার্চ দশম শ্রেণির একটি অনির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছিলেন হৃদয় মণ্ডল। সেখানে একজন ছাত্র বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করে কিছু প্রশ্ন করে। হৃদয় মণ্ডল সেগুলোর জবাব দেন।

ক্লাসের এক ছাত্র ওই আলোচনা মোবাইলে রেকর্ড করে এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুদিন পর কিছু ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন মিলে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে থানায় নিয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে।

ওই রাতেই স্কুলের অফিস সহকারী আসাদ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করলে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে, যা নানামুখী আলোচনার জন্ম দেয়।

পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, হৃদয় মণ্ডলকে ‘ফাঁসানোর জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে’ একটি মহল। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। 

শিক্ষাবিদ, অধিকারকর্মী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এর প্রতিবাদে সরব হয়। শ্রেণিকক্ষের আলোচনা এভাবে গ্রেপ্তারে গড়ালে দেশে বিজ্ঞান শিক্ষকদের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেন কেউ কেউ।

এর মধ্যে ২৮ মার্চ মুন্সীগঞ্জের বিচারিক হাকিম আদালতে জামিন আবেদন করেন হৃদয়, তা নাকচ করা হয়। এরপর ৪ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করা হলে বিচারক ১০ এপ্রিল শুনানির দিন রাখে।

যে ধারায় হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ওই মামলা ককরা হয়েছে, এবং জামিন না দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কমিশনের একজন সাবেক চেয়ারম্যান।

রোববার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সিরাজ ইসলাম পল্টু। হৃদয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহীন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ, মিল্টন বসু, সাইদুর রহমান, পঙ্কজ বাড়ৈ, আবুল আল মামুন, মনিরুজ্জামান মনির, দীপু চক্রবর্তী, অভিষেক চক্রবর্তী, প্রদীপ পাল, গোবিন্দ মণ্ডল, জীতেন্দ্র চন্দ্র বর্মন, আব্দুর রহমান, নিখিল চন্দ্র মণ্ডল, প্রমোদ চক্রবর্তী, আয়েশা আকতার বকুল, মামুনুর রশীদ, অপু বিশ্বাস, গোলাম মাওলা তপন, শহীদ ই হাসান তুহিন।

আইনজীবী শাহীন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত কোনো তারিখ বা সময় উল্লেখ করেননি, তবে এটা স্থায়ী জামিন। অন্তবর্তীকালীন জামিন হলে এখানে সময় ও তারিখ উল্লেখ থাকত।”

তিনি বলেন, “যে কুচক্রী মহল এদেশকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করতে চেয়েছিল ধর্মকে ইস্যু করে, হৃদয় মণ্ডলের মত একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে যে রকম বিপদে ফেলতে চেয়েছিল, সেটা তারা পারেনি। কারণ হৃদয় মণ্ডল ক্লাসে বলেছিলেন, বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস।”

আদালত থেকে জামিন নামা কারাগারে পৌঁছালে বিকালের মধ্যেই হৃদয় মণ্ডল মুক্তি পেয়ে যাবেন বলে আশা করছেন তার আইনজীবী।

মুন্সীগঞ্জ জেলা হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট অজয় চক্রবর্তী বলেন, “এই শান্তিপূর্ণ এলাকায় সাম্প্রদায়িক বীষবাষ্প ছড়ানোর অপচেষ্টা যারা করছেন, তাদের ব্যাপারে সরকার তথা প্রশাসনের নজর থাকা উচিত।

“এই যে ঘটনাটি, এটা শিক্ষকরাও ছাত্রদের দিয়ে করিয়ে থাকতে পারে। অনেক সময় প্রাইভেট টিউশন নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকে। সে একজন ভালো শিক্ষক, তাকে যদি সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেখানে এসে আরেকজন সেই সুবিধাটুকু নেবে।”

হৃদয় মণ্ডলের অন্যতম আইনজীবী অজয় চক্রবর্তী বলেন, “বিজ্ঞানের ক্লাসে ধর্ম জড়িয়ে নানা রকম প্রশ্ন এবং তা মোবাইলে রেকর্ড করার পেছনে কারা- এই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। ২০ মার্চ প্রথম ঘটনাটি ঘটল, তারপর ২২ মার্চ বিস্ফোরণ করার পেছনে কারা কলকাঠি নেড়েছে তা খুঁজে বের করা উচিত। কীসের কারণে এই ঘটনা, যিনি এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, তিনি বিষয়টি দেখবেন, সঠিক কারণটি খুঁজে বের করবেন, এটাই কাম্য।

জামিন শুনানির সময় হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা মণ্ডল এবং তাদের দুই সন্তানও উপস্থিত ছিলেন আদালতে।

স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত দুই সপ্তাহ যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে ববিতা বলেন, “আমার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে। আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল।… এক একটা দিন মনে হয়েছে এক একটা বছর। আমার ছেলেমেয়েরা বাবার জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেছে।”

হৃদয় মণ্ডল মুক্তি পাওয়ার পর তাদের পুরো পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তার স্ত্রী। 

“আমার স্বামী যেন আবার আগের মত স্কুলে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা যাতে করা হয়। সেই সাথে মামলাটির একেবারে নিষ্পত্তি যেন করা হয়।”

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মনিরুজ্জামান শরীফ বলেন, “দুটি বিষয়ে খোঁজ নেওয়া দরকার। প্রথমত বিদ্যালয়ের ভেতরে প্রাইভেট পড়নো নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটনাটি ঘটেছে কিনা। অপরটি হল, সেদিন ছাত্রদের উসকে দেওয়ার পেছনে মাইজভাণ্ডারীর সাথে জড়িত কিছু লোকজনকে বিদ্যালয় কম্পাউন্ডে বেশ তৎপর দেখা গেছে।”

পুলিশ ওই ঘটনার পেছনের কারণ উদঘটানে কাজ করছে জানিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. মিজান বলেন, এ পর্যন্ত ১০ জনের সাক্ষ্য তিনি নিয়েছেন।

“ওই ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির সদস্যের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের দেওয়া অভিযোগ, হৃদয় মণ্ডলকে শোকজ করার পত্র, ১৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডটি সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।”