সম্প্রতি ভারতের মেঘালয়ে বেশি বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় কিছু ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অনেক কৃষকের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। তাছাড়া আরও কিছু বাঁধে ফাটল ও ধস দেখা দেওয়া বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
প্রকৌশলী জহিরুল বলেন, “পাহাড়ি ঢল জেলার সব নদ-নদীতে উপচে প্রবাহিত হওয়ায় সব হাওরের ফসল ঝুঁকির মধ্যে আছে। কারণ গত তিন দিনে ঢলের পানি হাওরের কাচা বাঁধগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
“আমরা প্রতিটি বাঁধকেই মনিটরিংয়ের আওতায় রেখে বাস্তবায়নকারী পিআইসিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছি। আমরা বাঁশ, বস্তাসহ আপৎকালীন বাঁধ রক্ষায় বিভিন্ন জিনিস সরবরাহ করে রেখেছি। আমাদের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা ও পুরাতন সুরমাসহ সব নদ-নদীর পানি কিছুটা কমছে। এ সময় সুরমার পানি ৫.১৯ মিটার, যাদুকাটার পানি ৪.৬০ মিটার আর পুরাতন সুরমার পানি ৪.৬৬ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়।
বাপাউবোর আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাতে তিনি জানান, আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা ভারতের মেঘালয় ও আসাম প্রদেশে ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এই সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে দ্রুত পানি বাড়তে পারে, যার প্রভাব দ্বিতীয়বারের মত পড়বে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমলচন্দ্র সোম শুক্রবার বিভিন্ন উপজেলায় হাওর ঘুরে দেখেছেন।
তিনি বলেন, “কৃষক নদীতে পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখে আতঙ্কিত। বাস্তব কারণে এখনও সুনামগঞ্জের সব হাওরের ফসল ঝুঁকির মুখে আছে। তবে যদি এক সপ্তাহ ভারি বৃষ্টি না হয় তাহলে কৃষক ফসল কাটতে শুরু করতে পারবে।”
জেলার শাল্লা উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওর ছায়ার হাওর। গত ৫ এপ্রিল থেকে এই হাওরের বাহাড়া ইউনিয়নের শোধনখল্লী গ্রামের সামনে বিশাল গর্ত সৃষ্টি হলে আতঙ্ক দেখা দেয়। খবর শুনে ইটনা, মিঠামইন ও খালিয়াজুরি এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষক বাঁশ, কোদাল, বস্তা নিয়ে ছুটে যান। বিশেষ ব্যবস্থায় আনা হয় ট্রাক ও এক্সকাভেটর মেশিন। রাত-দিন মাটি কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের পেছনে একটি ছায়া বাঁধ দিয়ে বাঁধটি টিকিয়ে রেখেছেন হাজার হাজার কৃষক।
ওই গ্রামের কিষাণী আভা রানি বলেন, “আমাদের একমাত্র ফসল এই বোরো। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই বাঁধে ছুটে গিয়ে কাজ করি। গ্রামের সবাই নির্ঘুম ছিল। যদি আবার বৃষ্টি হয় তাহলে আর রক্ষা হবে না।“
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের হাওর চন্দ্রসোনার থাল। তিন দিন আগে কংস নদীর তীরের হাওরটির বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে। এখন এই হাওরের পানি চাপ সৃষ্টি করেছে একই ইউনিয়নের রাজপুর গ্রামের পাশের ধারাম হাওরে। রাজাপুর থেকে মুক্তারপুর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দৈর্ঘে্যর ডুবন্ত পাকা বাঁধটি মাটি ফেলে উঁচু করা হচ্ছে।
রাজাপুর গ্রামের কৃষক মো. স্বপন বলেন, “আমরা ভয়ে আছি। কংস নদীর পারে ডুবাইল বাধ ভেঙে আমাদের চন্দ্রসোনার থাল হাওর ডুবে গেছে। এখন পাশের হাওর ধারাম নিয়ে আমরা চিন্তায় আছি। এই হাওর চলে যাওয়ার পর আমরা দাবি জানিয়েছিলাম আমাদের ধারাম হাওরটি রক্ষার জন্য। এই হাওরে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি আছে। এখনও জমির ধান কাঁচা।”
রাজাপুর গ্রামের কৃষক মিলন মিয়া বলেন, “আমরা এখন ধারাম হাওর রক্ষায় কাজ করছি। আমাদের পাশের হাওর তলিয়ে গেছে। এই হাওরের পানি এখন চাপ সৃষ্টি করেছে আমাদের হাওরে। তাই পাকা ডুবন্ত সড়কে মাটি ফেলে উচু করা হচ্ছে। আমরা কৃষকরা কাজে সহযোগিতা করছি। আরও এক সপ্তাহ সময় বৃষ্টিবাদল না থাকলে আমাদের চিন্তা কমবে।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩৭টি হাওর রয়েছে। হাওরগুলোয় বেড়িবাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। তবু প্রায়ই বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে। কৃষকরা স্থায়ী, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু স্থায়ী বাঁধের পরিবেশগত সমস্যাও রয়েছে। কোথাও কোথাও সেগুলো খতিয়ে দেখছে সরকার।