সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার ২০টি অটো রাইস মিলের মধ্যে অনুমোদন আছে ১০টির; আর তার মধ্যে ১৭টি পরিবেশ আইন মেনে স্থাপন করা হয়নি।
এসব কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে জমির উৎপাদন কমছে, বিবর্ণ হচ্ছে গাছপালার পাতা; নদী-খাল-বিলের পানিও দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া বয়স্ক ও শিশুরা শ্বাসকষ্টজনিত অসুখবিসুখে ভুগছেন।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ঘুরে এসবের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য।
লোকালয় ও কৃষিজমি ঘেঁষে গড়ে ওঠা চালকলে পরিবেশ দূষণের প্রমাণ থাকলেও মিল মালিকদের বক্তব্য ‘অটো রাইস মিল চালালে কিছু ক্ষতি হবে, আবার উপকারও হবে।'
দুষণ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর, ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ বলেন, "যারা ছাড়পত্র নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই নবায়ন করছেন না। মিলগুলো সময়ের অভাবে পরিদর্শন করা হয়নি।"
জেলায় অনুমোদিত ১০টি চালকল সম্পর্কে মাদারীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় বলছে, "এর মধ্যে রাজৈর উপজেলায় সাতটি, কালকিনিতে দুটি ও সদরে একটি চালকল রয়েছে। মালিকেরা নিজ উদ্যোগে চালকল স্থাপনের পর খাদ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই উৎপাদন শুরু করেন।"
রাজৈর উপজেলার সাতটি চালকলের মধ্যে হোসেনপুর ইউনিয়নের তাঁতিকান্দি গ্রামেই চারটি স্বয়ক্রিয় কল রয়েছে। বাকি তিনটি অন্য গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সরেজমিনে রাজৈরের তাঁতিকান্দির মেসার্স জবেদা অটোরাইস মিলটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মিলের চুল্লি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে তুষের ছাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
ভেতরে স্বাস্থ্যসম্মত কোনো ব্যবস্থা না রেখে শ্রমিকেরা কাজ করে চলেছেন; তাদের শরীর ও মুখে কালো ছাইয়ের আস্তরণ পড়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও চালকলটিতে বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সব বর্জ্য গিয়ে পড়ছে পাশের কুমার নদে।
এসব মিল চলতে থাকলে ‘এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে’ মন্তব্য করে তাঁতিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার শেখ বলেন, "মিলের কাছাকাছি ১০ মিনিট দাঁড়ানো যায় না। ছাই উড়তে থাকে পুরো এলাকায়। গাছপালার পাতা কালো হয়ে গেছে। গাছে নতুন করে কোনো ফল ধরে না।"
মিল চালালে ‘কিছু ক্ষতি হবে’ মন্তব্য করে মেসার্স জবেদা অটো রাইস মিলের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, "অটো রাইস মিল চালালে কিছু ক্ষতি হবে, আবার উপকারও হবে। এখানে সব নিয়ম মেনেই মিলটি করা হয়েছে। সবকিছুর অনুমোদন আছে আমাদের।"
হোসেনপুর ইউনিয়নের মাতুব্বরবাড়ি এলাকার ঘনবসতি ও ফসলি জমির মধ্যে গড়ে উঠেছে জননী অটো রাইস মিল। ২০১৯ সালে মিলটি উদ্বোধন করা হয়।
জননী অটো রাইস মিলের অবস্থান ঠিক আবাদী ক্ষেতের মাঝে। মিলটি থেকে গরম পানি, ছাই ও অন্যান্য দূষিত বর্জ্যে ফেলা হয় চালকলের পেছনে খোলা জায়গায়। ওই খোলা জায়গা থেকে বর্জ্য মিশে যায় ফসলের ক্ষেতে।
টেকেরহাটের মাতুব্বর বাড়ি এলাকার কৃষক আমানত শাহ বলেন, "মিলের দক্ষিণ পাশে আমার দুই বিঘা ধানি জমি আছে। মিলের দূষিত বর্জ্য জমিতে মিশে যাচ্ছে। দুই বছর ধরে জমিতে ধানের আবাদ অনেক কমে গেছে। আগের মতো ভালো নেই আমরা।"
দুই বছর ধরে চালকলের মিলের কারণে 'নরক যন্ত্রণা' ভোগ করছেন বলে জানান এই এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া।
"ছাই উড়ে অস্থির একটা অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। জমিজমা সব শ্যাষ। রাতদিন শব্দের সমস্যা তো আছেই। ধুলাবালিতে কানা হয়ে যায় সব। দুই বছর ধরে নরক যন্ত্রণায় আছি আমরা।"
অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে জননী অটো রাইস মিলের মালিক হেলাল মাতুব্বর বলেন, তারা শ্রম মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তরসহ সব ধরনের লাইসেন্স নিয়ে মিল চালাচ্ছেন।
দূষণ বন্ধে মিল কর্তৃপক্ষ থেকে করণীয় কিছু আছে কি না জানতে চাইলে প্রশ্ন এড়িয়ে যান এই চালকল মালিক।
এ ছাড়া রাজৈর উপজেলার কামালদী এলাকার মেসার্স সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ অটো রাইস মিল, নয়াকান্দির মেসার্স রতন অটো রাইস মিলসহ জেলার ১০টি চালকলকেই দূষণের অন্যতম উৎস বলছেন এলাকাবাসী।
পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে এই মিলগুলো বন্ধ চান হোসেনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান। কিন্তু মিল বদ্ধের পদক্ষেপ নিতে তাদের হাত পা বাঁধা জানিয়ে এই ইউপি চেয়ারম্যান পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেন।
"মিলগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চালানোর কথা বলে মালিকপক্ষ ইউপি থেকে অনাপত্তি সনদ নেয়। মিলের উৎপাদন শুরুর পর এলাকাবাসী আমাদের কাছে অভিযোগ জানায়, ছাই উড়ে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, নদীতে মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।
বিসিক শিল্পনগনরী গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মাসুদ পারভেজ বলেন, "রাজৈর উপজেলায় চালকলের মিলগুলো বেশি। যত্রতত্র গড়ে ওঠা এ মিলগুলোকে উপজেলায় একটি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করে সেখানে গড়ে তুললে পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের অনেক উপকার হবে। সরকারের কাছে আমরা সেই দাবি করছি।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাদারীপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বিডিনিউজ টোয়োন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "রাজৈর উপজেলায় এর প্রভাব বেশি পড়ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।"
অটো রাইস মিলের ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ ও ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলেও জানান এই কর্মকর্তা।।
নজর নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের
‘মিলগুলো সময়ের অভাবে পরিদর্শন করা হয়নি,’ বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ।
তিনি জানান, তিন-চারটি অটো রাইস মিলের ছাড়পত্র আছে। কয়েকটার আবেদন করা আছে। তবে যারা ছাড়পত্র নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নবায়ন করছেন না।
তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।
রাশেদ আরও বলেন, "অবৈধ রাইস মিলের বিষয়ে অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। তবে লাইসেন্স বা মিল বন্ধ করার এখতিয়ার আমাদের নেই। এটি খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে।"
ফসলি জমি এবং লোকালয়ে চালকল করার ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়ী করছে খাদ্য অধিদপ্তর।
ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলেন, "পরিবেশের ক্ষতি হলে তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারাই পদক্ষেপ নেবে। তা ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া একটি অটো রাইস মিলেরও অনুমোদন দেয় না খাদ্য বিভাগ।"
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফসলি জমি ও নদীদূষণ করে কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না।
"যারা এসব চালকল চালাচ্ছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কারখানার মালিককে সতর্ক করা হবে। তারপরও নির্দেশনা না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"