সকালে মাঠে কাজ করতে যাওয়ার সময় চান্দালী, নূর আলী, মুনসুর এবং জাহান আলী মৃতদেহগুলোর জন্য রাস্তার পাশে একটি বড়সড় কবর খোঁড়েন। তারপর গোসল, জানাজা, কাফন ছাড়াই মাটিচাপা দেওয়া হয় তাদের।
স্বাধীনতার পর কবরের মাঝখানে জাহান আলী নামে এক ব্যক্তি একটি বটের চারা রোপণ করে দেন। সেটি এখন মহীরূহ। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামের মানুষের কাছে এটি এখন ‘পাঁচকবর’ কিংবা 'পাকামাজার' হিসেবে পরিচিত।
সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পাঁচনল গ্রামের জাকাতুল্লার ছেলে সামছুর রহমান এখন ওষুধ ব্যবসায়ী। একাত্তরে তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরই পালিয়ে ভারতে চলে যান প্রশিক্ষণের জন্য। বাড়ি ফিরে এসে ধরা পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। সম্প্রতি দুই দফায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুনিয়েছেন সেই নৃশংসতার কথা।
এ ছাড়া ‘কলারোয়ার ইতিহাস’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন কলারোয়া সরকারি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ আবু নসর। সেখান থেকেও এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সামছুর রহমান (৬৭) বলেন, “সময়টা এপ্রিল মাস হবে। আমি তখন কলেজে পড়ি, প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। আমরা সেসময় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আমাদের নেতৃত্ব দিতেন কয়লা হাইস্কুলের (অবসরপ্রাপ্ত) প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রউফ। যুদ্ধের দামামা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আব্দুর রউফ, মতিয়ার, রশিদসহ আমরা কয়েকজন প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে চলে যাই। কিছুদিন পর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। আমরা তখন সবাই অবিবাহিত।”
“দেশে ফিরে আসার সংবাদটি রাজাকাররা পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়। তখন কলারোয়া থানার ওসি ছিলেন আব্দুল হামিদ। তার নির্দেশে বিহারি পুলিশ ওছিম খান কলারোয়ার বাড়ি থেকে প্রথমে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। তখন রাত প্রায় ৩টা হবে। পাকিস্তানিরা আমাকে রশিদ ও মতিয়ারের বাড়ি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যায়।”
সামছুর রহমান বলেন, “আমি জীবনের ভয়ে প্রথমে রশিদের বাড়িতে যাই। রশিদ তখনও ঘুমায়নি, বাইরে বসেছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হায়েনারা রশিদকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।”
কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনারা আমাদের মতিয়ারের বাড়িতে নিয়ে গেল।
“গভীর রাতে মতিয়ার তখন ঘুমিয়ে ছিল। তারা তাকে ধরে ফেলল। এরপর তাদের টার্গেট ছিল মুক্তিযোদ্ধা নুরু। মসজিদ থেকে তখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা নুরুর বাড়িতে অভিযান চালানো হল। আগেই নুরু সরে পড়ায় বাড়িতে তাকে পাওয়া গেল না।
সামছুর বলেন, “ভোরবেলায় আমাদের তিনজনকে কলারোয়া থানায় এনে হাজতখানায় আটকে রাখা হলো। আমরা আসার আগে তারা হামিদপুরের আব্দুর রাজ্জাক ও রঘুনাথপুরের রওশন আলীকে ধরে নিয়ে এসেছিল। আমাদের সামনেই থানার ভেতরে রওশনকে বেয়নেট চার্জ করল।
“পরদিন বিকাল ৪টার দিকে সামছুজ্জামান হামিদী থানায় এলেন। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি শেখ আবুল কাশেম, জালালাবাদের চেয়ারম্যান এরশাদ আলী তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা থানায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন।
“গাড়িতে আমরা তিনজন ছাড়া আরও তিনজন আগে থেকেই ছিল। তাদের কেশবপুর ও মনিরামপুর এলাকা থেকে ধরে আনা হয়েছিল। আমাদের ছয়জনকে নিয়ে গাড়ি চলল। ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ৫টা নাগাদ নাভারন সাতক্ষীরা মহাসড়কের শার্শার জামতলায় গাড়িটি থামানো হলো।
“এক এক করে গাড়ি থেকে সবাইকে নামানো হলো। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু গুলির শব্দ আর আর্তনাদ, চিৎকার। এভাবে আমি ছাড়া বাকি পাঁচজনকে ওখানে গুলি করে হত্যা করা হলো।”
সামছুর বলেন, “ওই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানি ওছিম খান। গুলির শব্দ, আর্তনাদ আর চিৎকারে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি কলারোয়া সরকারি কলেজের পাশে ওছিম খানের ভাড়া বাসায় আমি। ওছিম খান আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তোর মায়ের আকুতি আর বাবার অনুরোধে তোকে প্রাণে মারতে পারলাম না, বাঁচিয়ে রাখলাম।’”
ওছিম খান প্রথম চাকরি জীবনে ১৯৬৬ সালে কলারোয়ায় সামছুরদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সামছুরের মা-বাবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। চাকরি জীবনে বদলি হয়ে গেলে বাসা ছেড়ে দেন। বছর পাঁচেক পরে তিনি আবার কলারোয়ায় আসেন। তবে সেসময় তিনি কলারোয়া সরকারি কলেজের পাশে একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন।
সামছুর বলেন, “একাত্তরে ওই ওছিম খানই আমাকে আটক করেছিলেন। আটক করার পর তিনি আমার মা-বাবাকে চিনতে পারেন। তখন আমার মা আমাকে ছাড়ানোর জন্য তার পা জড়িয়ে ধরে জীবনভিক্ষা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা আমার মায়ের পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে বাড়ি মেরে মাটিতে ফেলে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ওছিম খানের সহযোগিতায় আমি সে যাত্রায় বেঁচে যাই।”
‘কলারোয়ার ইতিহাস’ গ্রন্থের একটি নিবন্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া’; এটি লিখেছেন একাত্তরে কলারোয়া সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি ও ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ। তিনি এখন আর নেই।
“এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় নূরুল হক ও তিনজন অবাঙালি কনস্টেবল। এই দুজন ছাত্রের সঙ্গে আরও তিনজনকে তারা সেখানে হত্যা করে যাদের পরিচয় আজও জানা যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবরটি পাকা করার ব্যবস্থা করে সরকার। কবরের মাঝখানে জাহান আলীর লাগানো বটগাছটি এই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।”
কলারোয়ার পরাণপুর গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শিক্ষক আব্দুর রহমান (৭০) ছিলেন মতিয়ার রহমানের নিকটতম প্রতিবেশী ও আব্দুর রশিদের বন্ধু।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্দুর রহমান বলেন, “মতিয়ার ও রশিদ ছিল আমার কাছের বন্ধু। একসঙ্গে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে পড়াশুনা করতাম। তারা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যায়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে তখন সহযোগিতা করতাম।
“ওই রাতে আমাকেও ধরার জন্য আমাদের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয়। রশিদ ও মতিয়ারকে ওই রাতে ধরে নিয়ে যায়। আমি আত্নগোপনে থাকায় ধরা পড়িনি। আমাকে না পেয়ে তারা গালাগালি করেন। আমার সন্তানসম্ভবা বড় বোনের বুকে পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে। এতে তার পেটের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়।
আব্দুর রহমান আরও বলেন, “পরের দিন ওদের মেরে ফেলা হয়েছে – এমন খবর পেয়ে আমার বাবা আব্দুর রাজ্জাক জামতলায় যান। সেখানে রশিদ ও মতিয়ারের মৃতদেহ দেখে তিনি চিনতে পারলেও অন্য তিনজনকে চিনতে পারেননি। তাদের দেহে মাংস নেই, ঝাঁঝরা হয়ে গেছে এবং অসংখ্য গুলির দাগ ছিল।
মৃতদেহ দেখে আসার পর আমার বাবা তাদের বাড়িতে প্রথম এ খবরটি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কলারোয়ার পাঁচনল গ্রামের আব্দুর রশিদের ভাই আব্দুর রাকিব (৬৫) বলেন, “আমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে রশিদ ছিল তৃতীয়। ওই সময় তার বয়স ছিল ২২-২৩ বছর। বিয়ে করেননি। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বিএ পড়তেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
“ঘটনার রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও রশিদ না ঘুমিয়ে ঘরের পিছনে বসেছিলেন। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই পাকিস্তানিরা আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। তার ধরার পিছনে গভীর হাত ছিল পীরজাদা সামছুজ্জামান হামিদীর। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমার ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায়।”
হত্যাকাণ্ডের পর সেদিন শার্শার সামটা গ্রামের জাহান আলী, তার চার ভাই ও ভাবি মিলে মৃতদেহগুলো প্রথম দেখেন। এদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল চান্দ আলী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওইদিন ভোরে আমরা ভাইয়েরা মাঠে যাচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে লাশ পড়ে থাকতে দেখে আমরা কবরের ব্যবস্থা করি। আমার ভাই জাহান আলী, ভাবি বারিছোন বিবি, নূর আলী, মুনসুর মিলে পাকা রাস্তার ধারে মাটি খুঁড়ে একটি কবরে ছয়জনকে সমাহিত করি। ওই নারী বাদে ওরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
“আমার ভাই জাহান আলী কবর খুঁড়ে, আমরা তাকে সহযোগিতা করি। আর ভাবি বারিছোন বিবি শহীদদের গায়ে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে দাফনের উপযোগী করে। কিন্তু জানাজা ও কাফনের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। যে বটগাছটি এই গণকবরের স্মৃতিকে বহন করছে সেই বটগাছটা জাহান আলীর লাগানো।”