অপারেশন করে ভারতে ফিরে যেতাম: আব্দুল মালেক

মেহেরপুর সরকারি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন কৃষক পরিবারের সন্তান আব্দুল মালেক। দেশের মাটিতে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়ে নেমেছেন যুদ্ধের মাঠে। মাঠে থেকে যেমন যুদ্ধ করেছেন, আবার ভারত থেকে সীমান্ত পার হয়ে গেরিলা হামলাও চালিয়েছেন।

মেহেরপুর প্রতিনিধিতুহিন আরন্য, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2022, 03:19 AM
Updated : 23 March 2022, 03:19 AM

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। প্রচণ্ড বর্ষায় খাবার ও শারীরিক সমস্যার মধ্যেও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন মেহেরপুরের এই সন্তান ও সহযোদ্ধারা।   

সেদিনের ১৭ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আজ ৬৮ বছরের প্রবীণ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। ফিরে গেছেন অর্ধশত বছর আগের সেই উত্তাল দিনগুলোতে। কথা বলেছেন মুক্তিযেদ্ধা হওয়ার জন্য অমুক্তিযোদ্ধাদের নানা অনিয়ম-অপকর্ম নিয়ে।

চার ভাই চার বোনের মধ্যে সবার বড় মালেক। বাবা কৃষক। পরিবারে অভাব, অনটন ছিল। এই সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে বরকত, ফজলু দুই মামাতো-ফুপাতো ভাইসহ তারা কলেজপড়ুয়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত অনারারি ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল মালেকের (৬৮) পৈত্রিক বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউনিয়নের যতারপুর গ্রামে। এখন পরিবার নিয়ে বসবাস মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ায়। সেখানে একটি অফিস নিয়েছেন, যেখানে অস্ত্রধারী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দিনের সময় কাটান।

এখানে বসেই কথা বলেন ১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

প্রথমেই তারা তিনজন চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধা ইউথ ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখান। সেখানে ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন ইউনুস আলী, যার নেতৃত্বে তারা ২৫-৩০ জনের একটি প্লাটুন অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে প্রথমে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের নদীয়ার কৃষ্ণনগর যান। সেখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাদের গ্রহণ করেন।

“পরে তিনি আমাদের নিয়ে বিহারে রওয়ানা হন। সেখানে অস্ত্র-গোলাবারুদ – এসএলআর, এলএমজি, এইচএমজি, স্টেনগান, গ্রেনেড চার্জ ও নিক্ষেপ, মর্টারসেল এবং মাইনস্থাপন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের শিকারপুর ক্যাম্পে যোগ দিই। আমরা সেখান থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে এদেশে ঢুকে গেরিলা যুদ্ধে অপারেশন করে আবার ভারতে ফিরে যেতাম।”

এই সময় প্রথমে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী। পরে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এই সেক্টরের দায়িত্বে আসেন।

পুরোপুরিভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়টা অগাস্ট বলে জানান মালেক।

“আমরা ছদ্মবেশ নিয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, ধর্মদাহসহ বিভিন্ন স্থানে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধসহ অসংখ্য গেরিলা অপারেশনে অংশ নিই। মুজিবনগরে পাক সেনাদের উপর হামলা করতে ভারতের হৃদয়পুর হয়ে মুজিবনগর ঢুকে মর্টার হামলা চালাই। ওইদিন চোখের সামনে মুড়ি বিক্রেতা এক ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলে পাক সেনারা। তার পরদিন দুই পাকসেনাকে গুলি করে মেরে আমরা মরদেহ ভারতের হৃদয়পুর ক্যাম্পে নিয়ে যাই। সেখানেই তাদের দাফন করা হয়।”

ভারতীয় ক্যাম্প থেকে মাসে তাদের ৬০ রুপি হাত খরচসহ পোশাক, জুতা, সামরিক খাবার, পর্যাপ্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ, থাকাও ব্যবস্থা করা হতো বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় ক্যাম্পের বাইরে থাকলে খাবার কষ্ট হতো। শুকনা খাবার খেয়ে বনে জঙ্গলে থেকে টানা ১৫ দিন যুদ্ধ করতে হতো। খুশি হয়ে লোকজন যা দিত তাই খেয়ে বেঁচে থাকতে হতো।

“একাত্তরের অগাস্টে বন্যা হলে পানিতে এই অঞ্চল ভেসে যায়। পরে পানি সরে গেলে ব্যাপক হারে চুলকানি, ঘা, চোখওঠা রোগ দেখা দেয়। তারপরও যুদ্ধ থামেনি। শেষে ভারতের বনগাঁ ক্যাম্পে গিয়ে মুস্তাফিজের অধীনে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও জোরালোভাবে যুদ্ধ নেমে পড়ি।”

যুদ্ধের মাঠ থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে ঝুঁকি নিতে হতো বলে জানান।

“তখন মাদার আলী বিশ্বাস পিচ কমিটির নেতা ছিলেন। তিনি মা বাবাকে হুমকি দিতেন। বলতেন ছেলেকে ধরিয়ে দিতে; না হলে সবাইকে প্রাণ দিতে হবে। সেই ভয়ে মা-বাবর সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারিনি ঠিকমতো। তিনবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি। কত পাক সেনাকে খতম করেছি তার হিসাব নেই।”

বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসংখ্য ছাত্র-যুবক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উল্লেখ করে মালেক বলেন, “তখন ভাতা, সনদ পাবো, সরকারি সুবিধা নিব এই চিন্তায় কেউ যুদ্ধ করেনি। চিন্তা ছিল দেশ স্বাধীন হলে নিজে স্বাধীন হব – এই চিন্তা। এ কারণে অস্ত্রধারী প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়নি।”

তিনি বলেন, এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান দিয়েছে। ভাতা দিয়েছে। তবে এই সম্মান ও সম্মানী ভাতা এখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“তাই এখনও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম (৬৯), বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমানসহ সঙ্গী সাথীদের নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কেবল অস্ত্রধারীরাই হবে মুক্তিযোদ্ধা। এখন মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তার অজুহাত দেখিয়ে সবাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছেন। জেলায় ৪৫২ জন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা এবং ১২৬ জন যোদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। এর মধ্যেই আছে অনেক গরমিল। তার উপর আবার আরও নতুন ৪৮৯ জনকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পাঁয়তারা চলছে। এগুলোর মধ্যে মন্ত্রী এমপিদের আত্মীয়স্বজনের নাম রয়েছে।”

২০১৭ সালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বৈধ কমান্ড ভেঙে দিয়ে এখন পছন্দের লোক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

এখন মুক্তিযোদ্ধা হতে ভারতের লাল তালিকায় নাম, গেজেট কিছুই লাগছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পছন্দের যে কেউ সাক্ষী দিলেই সে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “সংবিধানে বলা আছে – দীর্ঘ সংগ্রামের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বলা নেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই ইস্যুতে হাই কোর্টে রিট করেছি। শুনানির অপেক্ষায় আছে রিটটি।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করার জন্য পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। এখন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্মান ও আদর্শ রক্ষার জন্য ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে।

“যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভালো চাকরি পেয়ে শান্তিতে অবসরও নিয়েছি; কিন্তু কষ্ট হয় যখন দেখি স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা নির্ণয়ে এখনও যাচাই-বাছাই চলছে। ২০ হাজার টাকা ভাতার লোভে অমুক্তিযোদ্ধারা ক্ষমতার দাপটে সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে। তাই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে এখন খারাপ লাগে।”