দুধ বেচতে পাক ক্যাম্পে, দেখেছেন নির্যাতনের বীভৎসতা

একাত্তরে দুধ বিক্রি করতে প্রতিদিনই তাকে যেতে হতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে; সেখানেই তিনি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেন বাঙালি নারী-পুরুষের ওপর নির্মম নির্যাতন। কিশোর বয়সে দেখা সেই ঘটনা আজও তাকে শিউরে তোলে। তিনি গাইবান্ধার কার্তিক বিশ্বাস।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2022, 04:47 AM
Updated : 21 March 2022, 07:50 AM

১৯৭১ সালে কার্তিকের বয়স হবে ১১ বা ১২। থাকতেন গাইবান্ধা শহরের হিন্দু অধ্যুষিত কলেজ পাড়ায় (তৎকালীন জেলেপাড়া)। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। বাবা-মা নেই। থাকতেন ঠাকুরমার সঙ্গে। অভাবের সংসারে তিন-চারটি গাভীই ছিল পূঁজি। সেই সময় দুধ বিক্রি করেই চলত পরিবারটি।

এখনও স্মৃতিশক্তি প্রখর। সবকিছুই মনে আছে। গাইবান্ধা শহরের এক নম্বর রেলগেইটের দক্ষিণ পাশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি গাইবান্ধা জেলা শাখার কার্যালয়ের সামনে চা বিক্রি করেন। পরপর দুদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তিনি তুলে ধরেছেন জীবনের সেই অধ্যায়ের কথা।

গাইবান্ধার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রচিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘গাইবন্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য: গাইবান্ধা ফাউন্ডেশন’, ড. মো. মাহবুবর রহমানের ‘একাত্তরে গাইবান্ধা’ এবং মুহাম্মদ আজিজুল হকের ‘আমার উপলব্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা’ উল্লেখযোগ্য। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ গাইবান্ধা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরপর ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। তারপর ছুটিতে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমম্বয়ে ২৭ মার্চ গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনী। সেইদিন থেকেই গাইবান্ধা কলেজ, আনসার ক্যাম্প ও ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধায় প্রবেশ করে। এ সময় তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের মুখে পড়তে হয় এবং অনেক সৈন্য হারাতে হয়। তারা গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়াম) ঘাঁটি স্থাপন করে। প্রতি রাতেই অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশে কফিল শাহর গুদাম এলাকায় মাটিচাপা দিয়ে রাখত।

পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা করতে গঠিত হয় মহকুমা শান্তি কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক হলেন সাবেক মুসলিম লীগ নেতা খন্দকার আজিজুল ইসলাম। সদস্যরা হলেন মুসলিম লীগ ও জামাতপন্থি লোকজন। রাজাকাররা আওয়ামী লীগ নেতা ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়িঘর ও দোকান লুটপাট শুরু করে।

সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে কার্তিক বিশ্বাস বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী গাইবান্ধায় আসার পর শহর থেকে লোকজন যে যেখানে পারে চলে যায়। গোটা শহর হয়ে যায় ফাঁকা। এ কারণে দুধ বিক্রি করার উপায় ছিল না। তাই প্রতিদিন গাভীর দুধ দোহন করে ফেলে দিতাম।

“তারপর স্থানীয় শান্তি কমিটির মাধ্যমে গাইবান্ধা স্টেডিয়ামের পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে দুধ বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি হয়। শান্তি কমিটির সদস্যরা আমাকে ‘আবদুল্লাহ’ নামে একটি কার্ড করে দেয়। সেই কার্ড নিয়ে প্রতিদিন ক্যাম্পে যেতাম দুধ দিতে।

“ওরা পয়সা দিত না। দুধের বদলে চাল দিত। আর সেই চাল দিয়ে ‘মলা’ (মোয়া) বানিয়ে বেচতাম। এভাবেই চলতো দুইজনের সংসার। ছোট ছিলাম বলে ক্যাম্পের ওরা আমাকে আদরও করত। অনেক সময় গাড়িতে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত।”

কার্তিক বলেন, “একদিন এক সেনা সদস্য আমাকে বললেন, ‘এই বাচ্চা, জয় বাংলা দ্যাখতা হায়’? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দ্যাখতা হায়’। তখন সেনা বললেন, ‘চল ওধার মে’…। বলে, আমাকে ওরা গাইবান্ধা স্টেডিয়ামের পাশে কফিল শাহর গোডাউনে নিয়ে যায়।

“গিয়ে দেখি, বেশ কয়েকজন যুবতীকে দুই হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। গায়ের মধ্যে এক টুকরা সুতাও নাই, উলঙ্গ। বুকের থন (স্তন) কেটে দিছে, গড় গড় করে রক্ত পড়ছে। আর ‘পানি পানি‘ বলে চিৎকার করছে।

“এ সময় পাক সেনা একটি পাত্রে প্রস্রাব করে ওই নারীর মুখে চটকা মারছে (ছিটিয়ে দিচ্ছে)। এভাবে রক্ত ঝড়তে ঝড়তে এক সময় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়লে ওই গুদাম চত্বরেই তাদের মাটিচাপা দিয়ে রাখত।

কার্তিক আরও বলেন, পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিন গাইবান্ধা শহর ও গ্রাম-গঞ্জ থেকে কিশোরী-যুবতী এবং বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের ধরে ধরে নিয়ে আসত। এরপর কফিল শাহর গোডাউনের লম্বা দালানের পুবদিকের ঘরটির মধ্যে নারীদের ঠাসাঠাসি করে রাখত। আর আলাদা একটি ঘরে পুরুষদের রাখত।

“দিন-রাতে যখন যার অর্ডার হতো গোডাউন চত্বরে তাদেরকে দিয়ে দুই পাশে মাটি খুঁড়ে লম্বা গর্ত করে নিত। এরপর দুই গর্তের মাঝখানে ১০-১২ জনকে পিঠমোড়া করে হাত ও চোখ বেঁধে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করাত। তারপর এক পাশ থেকে গুলি করত। এতে কেউ মারা যেত, আবার কেউ আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকত। এভাবেই তাদেরকে দুই পাশের গর্তে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখত।”

তিনি বলেন, “এই ছিন (দৃশ্য) দেখি আমার মাথা খারাপ হয়্যা গেল। ভাবলাম, এরা তো একদিন আমাদেরকেও মারি ফেলবে। আর আমি এদেরকে দুধ খাওয়াচ্ছি। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ঠাকুরমাকে ফেলে রেখে যমুনার চর পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাই। পরে দ্যাশ স্বাধীনের পর বাড়িত আসি শুনি, ভারতোত যাওয়ার পরপর আমার ঠাকুরমা মারা গ্যাচে।”

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকিস্তানি হানাদাররা যুদ্ধের সময় শহরের ব্যবসায়ী বিজয় কুমার রায়, পরেশ নাথ প্রসাদ, কেদার নাথ প্রসাদ, রামবাবু সাহা, জগৎ কর্মকার, ননী সাহা, মদন মহন দাস, উপেন্দ্র চন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র রায়, আনোয়ার হোসেনসহ অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে। এ সংখ্যা হাজারের অধিক। 

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্রের কালাসোনা চর দিয়ে গাইবান্ধা শহরের দিকে এগোতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুটি বিমান গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বোমা ফেলে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর তিনটি ট্যাংকসহ কর্নেল দত্তের নেতৃত্বে ভারতীয় যৌথবাহিনী সাদুল্লাপুর হয়ে দুপুরে গাইবান্ধা রওনা হয়।

ওইদিন সকালেই কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহি রঞ্জুর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সকাল ১০টার মধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যায় পাকিস্তানি সেনারা।

কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাকিস্তানি শত্রুরা গাইবান্ধা ছেড়ে চলে গেলে, পরদিন কফিল শাহর গোডাউনে গিয়ে দেখি ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর (ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক) ভাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে আছে।”

জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক জি এম চৌধুরী মিঠু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাগার নির্মাণে দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

“তবে জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে প্রতি বছর ২৫ মার্চ মোমবাতি জ্বালিয়ে এ বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়,” যোগ করেন মিঠু।