একাত্তরে নির্যাতিতাদের সেবা বড় অর্জন: ডা. বদরুন নাহার

১৯৭১ সালে সৈয়দা বদরুন নাহার ছিলেন মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওই জ্ঞান নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। পুরো সময় যুদ্ধের মাঠে কাটিয়েছেন আহত মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিতা নারীদের সেবায়। কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যান।

আল ইমরান শোভন চাঁদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2022, 03:22 AM
Updated : 19 March 2022, 03:22 AM

স্বাধীনতা পদক পাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, যুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের সেবা করতে পারাটা ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী ১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ দরবেশ আলী ও মা সৈয়দা হোসনে আরা বেগম। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র চাঁদপুরের সন্তান তোফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। যুদ্ধক্ষেত্রও বেছে নেন বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে যাওয়া এই নারী যোদ্ধা যুদ্ধদিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন। যুদ্ধের ঘটনাগুলো বর্ণনা করার সময় কখনও গর্বে মুখ উদ্ভাসিত হয়েছে; কখনও নির্যাতিতাদের কষ্টের বিবরণ দিতে গিয়ে বেদনায় নীল হয়েছেন।

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও নির্যাতিতা নারীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। চিতোষী এলাকায় একটি বিদ্যালয়ে পাক সেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমি নৌকায় দূরে ছিলাম। আমার কাছে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান খবর পাঠান, ওই বিদ্যালয়ে পাক সেনারা কিছু মহিলাকে আটকে রেখেছে এবং পাশবিক নির্যাতন করেছে। খবর পেয়ে আমি রওয়ানা দিলাম। পাঠান বাহিনী ইতোমধ্যে পাক বাহিনীর ওই ঘাঁটি আক্রমণ করে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনারা কিছু লাশ এবং কয়েকজন মহিলাকে সেখানে রেখে পালিয়ে যায়। আমি সেই বিদ্যালয়ের ভেতরে গিয়ে দেখলাম ১২ থেকে ১৩ জন মহিলা। পাক সেনাদের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিটি চিহ্ন তাদের গায়ে। তারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় সেখানে ছিল।”

ওই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বদরুন নাহার যেন সেদিনের কষ্টের দিনগুলোতে ফিরে যান।

“সেই স্মৃতি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে এবং তাদের কথা স্মরণ করলে এখনও আমি কান্না ধরে রাখতে পারি না।”

তিনি বলতে থাকেন, “এ অবস্থায় আমার কিছু কাপড়-চোপড়, আমাদের সাথীদের কাপড়-চোপড় এবং আশপাশের মানুষদের সহায়তায় তাদেরকে [বিদ্যালয় থেকে উদ্ধার নারী] কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ফেলি। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা দিই। শুধু তাই নয়, আমি যে নৌকায় থাকতাম এবং যেটায় করে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, সেই নৌকায় করে তাদের নিয়ে আসি। সে সময় আমার কাছেও খুব বেশি ওষুধপত্র ছিল না। তবু সেসব দিয়েই তাদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলি। পরে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের পৌঁছে দেই।

“আমার কাছে এখনও মনে হয়, আমার চিকিৎসক জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো – আমি সেই নির্যাতিত মহিলাদের চিকিৎসা সেবা দিতে পেরেছি।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ডা. বদরুন নাহার। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি এবং তার স্বামী ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে চাঁদপুরে চলে আসেন। চাঁদপুরে পৌঁছেই সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২০৪ সাব-সেক্টরের অধীনে জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন মধুমতী কোম্পানিতে মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন ডা. বদরুন নাহার। ওই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ওলিপুর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো নয় মাস তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে ছিলেন। এ সময় তিনি অধিকাংশ সময় নৌকায় করে সহযোদ্ধাদের সেবা করেছেন।

রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন এই নারী যোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ছুটে যান গ্রামের পর গ্রামে। একাধিকবার তার নৌকা পাকিস্তানি সেনারা আটক করে। নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান।

একদিনের ঘটনার স্মৃতচারণে বলেন, “ফরিদগঞ্জ এলাকায় আমাদের ক্যাম্পের একটি ছেলে সম্মুখযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়। তার নাম ফারুক। আমার কাছে তখন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। তবুও আমি তার শরীরের গুলি বের করতে সক্ষম হই। কিন্তু তার যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, তা কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি। এমনকি তাকে তখন অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না। ফলে আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে মারা যায়।”

চাঁদপুরসহ কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধের সময় কোনো এলাকায় বেশি দিন অবস্থান করতে পারতেন না। কোনো বাড়িতে দুয়েকদিন থাকলেই এলাকায় খবর হয়ে যেত – এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছে। সে কারণে জায়গা বদল করতে হতো। এছাড়া দিনের বেলায় চলাফেরা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। তাই রাতের আঁধারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন।

কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরার পড়ার উপক্রম হয়েছিল; সে প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় বড় একটা সেতু আছে। ওই সেতুর নিচ দিয়ে যখন আমার নৌকা যাচ্ছিল, তখন পাকসেনারা আমাকে থামায়। কিন্তু যুদ্ধের সময় থেকে আমি আমার স্বাভাবিক কাপড়-চোপড় না পরে বরং বোরকা পরে ছদ্মবেশে থাকতাম। ওরা আমার নৌকা আটকায়। আটকিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে। তখন মাঝি কোনো একটা জায়গার নাম বলেন, আমাকে সেখানে রাখতে যাচ্ছেন বলে তাদের জানান। আমার দুয়েকটা কথাবার্তাতেও তারা আমাকে আর সন্দেহ করেনি। ফলে সে দফা ছেড়ে দেয়।

“আরেকবার অনেক রাত্রে আমি নৌকায় করে যাচ্ছি। পাকসেনারা আমার নৌকা আটকায়। তখন আমার মাঝি আমাকে বললেন – ‘খালাম্মা, আপনি পানিতে নেমে যান’। আমি তো প্রথমে খুব আঁৎকে উঠলাম তার কথা শুনে। কিন্তু উপায় নেই দেখে শেষ পর্যন্ত পানিতে নেমে পড়ি। নৌকার পেছন দিক ধরে পানিতে আস্তে করে ভাসতে থাকি। পাকসেনারা নৌকাটা ভালোভাবে দেখল, কেউ নেই। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন তিনি খালি নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তখন ওরা নৌকাটা ছেড়ে দিল। আমি যখন নৌকা ধরে পানিতে ছিলাম তখন আমার মনে হলো পাশ দিয়ে কি যেন ভেসে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে জীবনের ভয় তো সবারই হবে। তারপর সৈন্যরা যখন চলে গেছে তখন আমি দেখলাম, আমার পাশ দিয়ে দুই তিনটা মৃতদেহ ভেসে গেছে।”

দেশ স্বাধীনের পর এমবিবিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করেন সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী। চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। সবশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত আছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য ২০১২ সালে ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরীকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।