নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন নাহার জানান, শুক্রবার সদর উপজেলার চওরাবড়গাছা ইউনিয়নের দলবাড়ি গ্রামে এই ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, মৃত প্রাণীটি যে একটি চিতা বাঘ, রংপুর বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা তা নিশ্চিত করেছেন। সেই বাঘের সঙ্গী আরেকটি চিতা বাঘ ওই এলাকায় আত্মগোপন করে আছে বলেও এলাকাবাসী ধারণা করছে।
মৃত বাঘটি উদ্ধার করে বন বিভাগের হেফাজতে রাখা হয়েছে। আরেকটি চিতাবাঘ আত্মগোপন করে থাকার শঙ্কায় এলাকার মানুষজনকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এলাকায় পুলিশ প্রহরা বসানো হয়।
এছাড়া জীবিত চিতা বাঘটি উদ্ধারে রংপুর বন বিভাগের কর্মকর্তাসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন বলেও জানান ইউএনও জেসমিন নাহার।
স্থানীয়দের বারত দিয়ে চওরাবড়গাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বিটু জানান, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে গ্রামের ওলিয়ার রহমানের মুরগির খামারের পিছনে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে একটি চিতা বাঘ মারা গেছে। এ সময় আরেকটি চিতা বাঘ ওই খামারের পিছনে দেখতে পান খামার মালিকের বাবা খতিব উদ্দিন। তিনি তার ছেলে ও জামাইকে খবর দিলে তারা এসে দেখতে পান একটি চিতা বাঘ বৈদ্যুতিক জড়িয়ে মারা গেছে এবং ওই বাঘের সঙ্গী পার্শ্ববর্তী ভুট্টা ক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে।
“বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা বন কর্মকতাকে অবগত করা হলে তারা এসে মৃত চিতা বাঘটি উদ্ধার করে নিয়ে যান। তবে জীবিত থাকা অপর চিতা বাঘটি এখনও উদ্ধার না হওয়ায় আতংকে রয়েছে গ্রামবাসী।”
মুরগির খামার মালিক ওলিয়ার রহমান বলেন, খামাড়টিতে তিন হাজার মুরগি রয়েছে। গত এক মাস থেকে প্রতিরাতেই খামারে বন বিড়াল ও শিয়াল হামলা করে গড়ে ১০ থেকে ১৫টি করে মুরগি বের করে নিয়ে যাচ্ছিল।
“দুই সপ্তাহ আগে পুরো খামারটি জিআই তার দিয়ে ঘেরার পর বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করি। এতে ওই বৈদ্যুতিক তারে শক খেয়ে পাঁচটি বনবিড়াল ও একটি শেয়ালের মৃত্যু হয়।”
ওলিয়ার রহমান বলেন, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে তার বাবা জানান বড় একটা জন্তু খামারের বৈদ্যুতিক তারে আটক হয়েছে; আরেকটি বড় জন্তু বিকট শব্দে আহাজারি করছে।
“খবর পেয়ে আমি ও আমার দুলাভাই খামারে গিয়ে দেখি খামারের বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মরে রয়েছে একটি চিতা বাঘ; আর সেখানে আরেকটি চিতা বাঘ আহাজারি করছে।”
ওলিয়ার রহমান জানান, সকাল ৬টার দিকে মানুষের উপস্থিতি বাড়লে আহাজারিরত চিতা বাঘটি খামার সংলগ্ন ভুট্টা খেতে লুকিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে নীলফামারী সদর থানা পুলিশ ও বন বিভাগের লোকজন এসে মৃত বাঘটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
“এর আগে কখনও এলাকায় এমন বাঘ আছে আমি শুনিনি। হঠাৎ করে বাঘের দেখা পাওয়ায় আমিসহ এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছি।”
ওলিয়ারের বাবা প্রত্যক্ষদর্শী খতিব উদ্দিন বলেন, “রাত পৌনে ৩টার দিকে খামারের পিছনে বন্যপ্রাণীর আওয়াজ পেয়ে বৈদ্যুতিক শক লাইনের সুইচ চালু করি। এর কিছুক্ষণ পরই একটি বড় আকৃতির জন্তু বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যায়। এ সময় ওই জন্তুকে বাঁচাতে আরেকটি জন্তু সেখানে বিকট আওয়াজে আহাজারি করতে থাকে। এতে আমি ভয় পেয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে এবং জামাইকে ডাকাডাকি করি। পরে তারা এসে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখি যে জন্তু দুটিই চিতা বাঘ।”
প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহিম বলেন, সকালে খামাড়ের পিছন থেকে মৃত বাঘটির গলায় দড়ি পেঁচিয়ে বাইরে আনা হয়। এ সময় বাঘটি দেখতে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার মানুষ ভিড় জমায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় বন বিভাগের লোকজন এসে মৃত বাঘটি উদ্ধার করে নীলসাগরে নিয়ে যান।
নীলফামারী সদর ইউএনও জেসমিন নাহার বলেন, “নীলফামারী বন বিভাগের কর্মকর্তা কাছে নিশ্চিত হয়েছি যে বাঘ দুটি প্রচণ্ড ক্ষুধর্ত থাকায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে খাদ্যের সন্ধানে এসেছিল। মৃত বাঘটি উদ্ধার করে বন বিভাগের হেফাজতে রাখা হয়েছে। সঙ্গীয় বাঘটি ক্ষুধার্ত – এমন আশঙ্কায় ঘটনাস্থল থেকে মানুষজনকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এলাকায় পুলিশ প্রহরা রাখা হয়েছে।
“তবে কোথা থেকে এবং কীভাবে এই চিতা বাঘ দুটি এই গ্রামে এলো তা কেউ বলতে পারেনি। আমাদের জেলায় দক্ষ কোনো বন্যপ্রাণী কর্মকর্তা না থাকায় দুপুরের দিকে রংপুর থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন।”
রংপুর বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা স্মৃতি রাণী সিংহ বলেন, “মৃত চিতা বাঘটি উদ্ধার করা হয়েছে। সেটির ময়নাতদন্ত করা হবে। এছাড়ও এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী এখানে আরেকটি জীবিত চিতা থাকার সম্ভবনা রয়েছে – এমনকি তার রোষ শোনা গেছে। আমরা চিন্তা করছি সেটি কীভাবে উদ্ধার করা যায়। তবে এই চিতাটি দুয়েকদিনের মধ্যেই এই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে। এজন্য আমরা এলাকাবাসীকে নিরাপদে থাকতে বলেছি যাতে তাদের কেউ বাড়ি থেকে বের হয়ে এই খামার এলাকায় না আসেন।”
তিনি আরও বলেন, “যে চিতা বাঘটি মারা গেছে আমরা ধারণা করছি সেটি ভারতীয় সীমানা থেকে এসেছে। এই অঞ্চলেও চিতা বাঘ দেখা যেত আগে, কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় এখন আর চিতা বাঘ দেখতে পারছি না।”
এদের আবাস্থল হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আবাস্থল হারিয়ে যাওয়ায় এরা খাদ্য সংকটে পড়ছে। আজকে তারা মুরগির খামারে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা এভাবেই বিচরণ করে বেড়ায়। খাদ্য সংগ্রহের জন্য তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করে।
“যেভাবে এখানে চিতা বাঘের মৃত্যু হয়েছে তা সাধারণ মৃত্যু নয়; এটিকে হত্যা করা হয়েছে,” মন্তব্য করে স্মৃতি রাণী সিংহ বলেন, “এটি একটি হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৩৭ ধারায় এটি দণ্ডণীয় অপরাধ। যথাযথ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে খামার মালিকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”