মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে গণহত্যার খবর পেয়ে লাল ব্রিজের নিচে গিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী। সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন।
সবেদ আলী বলছিলেন, “মাটিচাপা দেওয়া বড় বড় কতগুলো গর্ত ছিল। সাত থেকে আটটা গর্ত হবে। এর মধ্যে আমরা একটা গর্ত খুঁড়ে প্রায় ৪০০ কঙ্কাল পেয়েছিলাম। আরেকটি গর্ত খুঁড়তে গিয়ে বিকট গন্ধ আসে, আর পারা যায়নি।”
স্থানীয় লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা ও মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে লাল ব্রিজ বধ্যভূমিতে। চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া রেলপথের আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে কুমার নদীর ওপর এই ব্রিজের অবস্থান।
জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের এই এলাকাটি একাত্তরে প্রায় নির্জন ছিল। চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল। মানুষের আনাগোনাও কম ছিল। ঝোপ-জঙ্গল কেটে হানাদার বাহিনী নিজেদের ক্যাম্প তৈরি করে নেয়।
স্টেশন ও সেতুর মাঝখানে গোটা কয়েক বাড়ি ছিল তখন। সেতুর কাছাকাছি কামালপুর, হাড়গাড়ি, কালিদাসপুর, হারদী গ্রাম। সেতুর এক পাশে ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালাসি ঘর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেই ঘরটিকেই ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “সেদিন দুপুরের পর ট্রেন থেকে হানাদার বাহিনী কয়েকজনকে নামিয়ে নেয়। তারপর তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলিবর্ষণ করে। সবাই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সবাই মারা গেছে ভেবে ওখান থেকে চলে যায় হানাদার বাহিনী।”
“ওইদিন হানাদার বাহিনীর গুলিবর্ষণে একজন বাদে সবাই মারা গিয়েছিলেন। যিনি বেঁচে ছিলেন তার গায়ে গুলি লাগেনি। কিন্তু তিনিও অন্যদের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন এবং মরার মতো করে লাশের সারিতেই ছিলেন।
বধ্যভূমি থেকে একজনের জীবিত ফিরে আসার বিষয়টি জানতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিনও। তিনি বলেন, কালিদাসপুর গ্রামের ইবারত মালিথা ছিলেন এ ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি এখন আর বেঁচে নেই।
মঈন উদ্দিন বলেন, “জুন মাসের প্রথম দিক থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত হানাদার বাহিনী নির্যাতন চালিয়ে মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে। আপ ও ডাউন ট্রেন থেকে বিশেষত যুবক-যুবতীদের ধরে নামানো হতো। দেশ স্বাধীনের পর এখন থেকে মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়েছে।”
দূর-দূরান্তের অনেক মানুষও এই বধ্যভূমি পরিদর্শনে আসে বলে জানালেন স্থানীয়রা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সবেদ আলী বলেন, ২০০৯ সালে লাল ব্রিজের পাশের ওই স্থানে বধ্যভূমি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে বধ্যভূমি নির্মাণকাজ শেষ হয়। আর্থিক সহায়তা এবং নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন।
সামাজিক সংগঠন ‘লোকমোর্চার’ আলমডাঙ্গা উপজেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “বধ্যভূমি নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সবেদ আলী এ নিয়ে দৌড়ঝাপ করছিলেন। বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।”
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন মাঝেমধ্যেই আলমডাঙ্গার বধ্যভূমি দেখতে আসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী লাল ব্রিজের কাছে ট্রেন থামিয়ে নারী-পুরষদের নামিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এই বধ্যভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা জানানো।”